ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র যারা ১৯ শতক থেকে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ভিয়েতনামে সংঘাতের সূচনা ঘটে ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫-১৯৭৫) সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন সমর্থিত কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনাম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। দীর্ঘ রক্তাক্ত সংঘাতের মূল কারন ছিল ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন এবং কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন কর্তৃক ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বিশ্ব আধিপত্যের জন্য লড়াই করেছিল তখন ভিয়েতনাম ছিল স্নায় যুদ্ধের একটি যুদ্ধক্ষেত্র। দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল নিয়ে আজকের আলোচনা। চলুন শুরু করা যাক।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ

১. ফরাসি ইন্দোচীনের পতন এবং হো চি মিনের উত্থান
১৮৭৭ সালে ফরাসি ইন্দোচীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভিয়েতনাম একটি ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জাপানি সৈন্যরা ভিয়েতনাম দখল করে তখন ফরাসিরা তাদের উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এবং ফ্রান্স এর দখলের বিরুদ্ধে বিপ্লবী নেতা হো চি মিন-এর অধীনে ভিয়েতনামে একটি স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠে। হো চি মিন ১৯৪১ সালের মে মাসে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার জন্য একটি লীগ প্রতিষ্ঠা করেন যা ভিয়েত মিন নামে পরিচিত।
২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর হো চি মিন ফ্রান্স থেকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু ফরাসিরা তার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে, ভিয়েত মিন একটি স্বাধীন ভিয়েতনামের জন্য লড়াই করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয় নেয়। ফলাফল হিসেবে যুদ্ধ শুরু হয়, এবং আট বছর যুদ্ধের পর ফ্রান্সকে ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে হয়।
২. দিয়েন বিয়েন ফু এর যুদ্ধ
ফরাসি এবং ভিয়েত মিনের মধ্যে চলা দীর্ঘ দ্বন্দ্ব ডিয়েন বিয়েন ফু-এর যুদ্ধের সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চার মাস অবরোধের পর, ফরাসিরা কমান্ডার ভো নুগুয়েন গিয়াপের অধীনে ভিয়েত মিনের কাছে হেরে যায়। ১৯৫৪ সালের মে মাসে, ডিয়েন বিয়েন ফু যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ে ইন্দোচীনে প্রায় এক শতাব্দীর ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে।
৩. ১৯৫৪ সালের জেনেভা চুক্তি
 
১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে, জেনেভা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে ভিয়েতনামকে ১৭ তম সমান্তরালে (১৭ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ) বিভক্ত করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী উত্তর ভিয়েতনাম শাসিত হবে হো চি মিনের কমিউনিস্ট সরকারের অধীনে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম শাসিত হবে সম্রাট বাও দাইয়ের নেতৃত্বে। এছাড়া জেনেভা চুক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনামকে একত্রিত করার জন্য দুই বছরের মধ্যে একটি নির্বাচন নির্ধারিত ছিল, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নির্বাচনে কমিউনিস্ট সরকারের বিজয়ের ভয় থেকে নির্বাচন হতে দেয়নি।
৪. স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের কারণে ভিয়েতনামে সংঘাত তীব্রতর হয়। স্নায়ু যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল।
স্নায়ু যুদ্ধের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘‘নিয়ন্ত্রণ নীতি’’ প্রবর্তন করে। রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস. ট্রুম্যানের ‘‘ট্রুম্যান মতবাদ’’ এর মাধ্যমে কমিউনিস্ট শক্তির হুমকির সম্মুখীন গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তীতে, প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার ‘‘ডমিনো তত্ত্ব’’ উপস্থাপন করেছিলেন যার মূল কথা ছিল ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট বিজয় হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াযর অন্যন্য অঞ্চলে কমিউনিস্ট ছড়িয়ে পড়বে এবং তাই সব মূল্যে এর প্রতিরোধ করতে হবে।
৫. এনগো দিন ডায়েম এর উৎখাত
সম্রাট বাও দাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হন ক্যাথলিক জাতীয়তাবাদী এনগো দিন ডায়েম। তার শক্তিশালী কমিউনিস্ট-বিরোধী অবস্থান আমেরিকানদের কাছে জনপ্রিয় ছিল যারা তাকে ক্ষমতায় উত্থান করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ক্যাথলিক সংখ্যালঘুদের প্রতি ডাইমের আচরণ দক্ষিণ ভিয়েতনাম জুড়ে বিক্ষোভের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে, হিউতে সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে আটজন বৌদ্ধ বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
জবাবে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থিচ কোয়াং ডুক সাইগনের রাস্তায় নিজেকে আগুন ধরিয়ে দেন। অন্যান্য সন্ন্যাসীরা নিজেদের আত্মহত্যা করতে শুরু করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডাইমের নেতৃত্বের উপর আস্থা হারায়। নভেম্বরে, ডিম এবং তার ভাই এনগো দিন নুকে হত্যা করার মাধ্যমে উৎখাত হয়।
৬. টনকিন উপসাগরের ঘটনা
টনকিন উপসাগরের ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রবেশে ভূমিকা রাখে। যদিও আমেরিকা পূর্ব থেকেই দক্ষিণ ভিয়েতনামকে বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
২ আগস্ট, ১৯৬৪ সালে, ইউ.এস.এস. ম্যাডক্স টনকিন উপসাগরে তিনটি সোভিয়েত-নির্মিত উত্তর ভিয়েতনামী টর্পেডো নৌকার মুখোমুখি হন। ৪ আগস্ট, ইউএস ডেস্ট্রয়ার টার্নার জয় এবং ইউ.এস.এস. ম্যাডক্স রিপোর্ট করেছেন যে তাদের অতর্কিত আক্রমণ করা হয়েছিল, যদিও টার্নার জয়ের অ্যাকাউন্টটি ইতিহাসবিদদের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আগস্ট ৭-এ, মার্কিন হাউস এবং সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে টনকিন উপসাগরীয় রেজোলিউশন পাস করে। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যেকোনও সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং আগ্রাসন রোধ করার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলাফল

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল স্নায়ুযুদ্ধের একটি দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘাত যা উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকার এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং তার প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের কারণে এই সংঘাত তীব্রতর হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ (৫৮,০০০ আমেরিকান সহ) নিহত হয়েছিল এবং মৃতদের অর্ধেকেরও বেশি ভিয়েতনামী বেসামরিক ছিল।
আমেরিকা সরাসরি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করে ১৯৬৫ সালে। কিন্তু এর আগেই তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক সহায়তা করে। ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণে যে পরিমাণ ভিয়েত কং মারা যাচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্ক যুবককে প্রতি বছর উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল। আর অনবরত বোমা হামলার মাধ্যমে অবকাঠামোগত ক্ষতি করা হয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল ভিয়েত কংরা।
যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় ও কার্যকরী কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা দেখা না পাওয়ায় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যম ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। দিনে দিনে মৃত আমেরিকান সৈন্যদের কফিন যতই মার্কিন বিমানবন্দরে ভিড়তে থাকে, ততই সরকারের সমালোচনা বাড়তে থাকে। মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আমেরিকানরা বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যেসব সাধারণ মানুষ মার্কিনীদের পক্ষে ছিল, তারাও পক্ষত্যাগ করে।

Similar Posts