আমরা আজকে আমাদের এই আর্টিকেলটি তে চেষ্টা করবো হৃদপিন্ড কাকে বলে এবং এর গঠন ও কাজ নিয়ে যাবতীয় তথ্য প্রদান করতে।
আমরা সকলেই জানি বেঁচে থাকার জন্য হৃদপিন্ড কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এর ভূমিকা বলে কখনও শেষ করা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত যে যখন হৃদপিন্ড তার কাজ বন্ধ করে দিবে তখন আমাদের জীবন চক্র ও থেমে যাবে।
তো চলুন দেখে নেওয়া যাক হৃদপিন্ড কাকে বলে এবং এর গঠন ও কার্যকারিতা কি।
হৃদপিন্ড কাকে বলে
রক্ত সংবহনতন্ত্রের যে অঙ্গটি পাম্পের মতো সংকোচন প্রসারনের মাধ্যমে সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করে তাকে হৃদপিন্ড বলা হয়৷
এই পাম্পটির জীবন রয়েছে অর্থ্যাৎ এটি জীবন্ত একটি পাম্প যা দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে শিরার মাধ্যমে আনীত রক্ত ধমনীর সাহায্য সারা দেহে পাঠায়। একজন সুস্থ মানুষের জীবদ্দশায় হৃদপিন্ড গড়ে ২৬০০ মিলিয়ন বার স্পন্দিত হতে পারে।
হৃদপিন্ডের ওজন কতো?
একটি স্বাভাবিক হৃদপিন্ডের ওজন প্রায় ৩০০ গ্রাম। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী লোকের হৃদপিন্ডের ওজন প্রায় এক তৃতীয়াংশ কম হয়ে থাকে। একজন প্রাপ্তয়স্ক পুরুষের হৃদপিন্ডের ওজন প্রায় ২৮০-৩৪০ গ্রাম এবং একজন নারীর হৃদপিন্ডের ওজন প্রায় ২৩০-২৮০ গ্রাম।
হৃদপিন্ড এর গঠন ও আকৃতি কেমন এবং এর অবস্থান কোথায়?
শাঙ্কু আকৃতির গঠন সম্পন্ন, অনেকটা চৌকো ধরনের দ্বিপর্দা বিশিষ্ট পেরিকার্ডিয়াম নামক পর্দা দ্বারা আবৃত স্টার্নামের পশ্চাৎ ভাগে ডায়াফ্রামের উপরে থােরাসিক বা বক্ষ গহ্বরে মিডিয়াস্টিনাম বরাবর দুইটি ফুসফুসের মাঝবরাবর , বামদিকে একটু হেলে অবস্থান করে এই হৃদপিন্ড ।
হৃদপিন্ড যে পেরিকার্ডিয়াম নামক পর্দা দ্বারা আবৃত তার বাইরের স্তর কে বলা হয় প্যারাইটাল স্তর এবং ভিতরের স্তর কে ভিসেরাল স্তর বলা হয়। দুই স্তরের মাঝখানে থাকে পেরিকার্ডিয়াল ফ্লুইড , এই ফ্লুইড হৃদপিন্ডকে বিভিন্ন ধরনের ঘর্ষন হতে রক্ষা করে৷
হৃদপিন্ডের যে পেশি থাকে তাকে মায়োকার্ডিয়াম বলে যা এন্ডোকার্ডিয়াম এর ঠিক নিচের দিকে অবস্থিত। হৃদপেশী অনৈচ্ছিক পেশী দ্বা্রা গঠিত।
হৃদপিন্ড কাকে বলে
হৃদপিন্ড এর সংযোগী কলা কোষ
১. SA node
২. AV node
৩. বান্ডেল অব হিজ
৪. পার্কিনজি তন্তু
১. SA node
এই SA node টি ডান অলিন্দের উর্ধ্ব মহাশিরার নিকটে অবস্থিত। এটি মিনিটে প্রায় ৭০-৮০ বার স্পন্দন সৃষ্টি করে। এটি হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক স্পন্দনকে নিয়ন্ত্রন করে বলে একে প্রাকৃ্তিক পেসমেকার বলা হয়ে থাকে।
২. AV node
এই সংযোগী কলা টি করোনারি সাইনাস এর নিকটস্থ আন্তঃঅলিন্দ প্রাচীর এর পিছনে্র দিকে অবস্থিত। এটি মিনিটে প্রায় ৬০-৪০ বার স্পন্দনের সৃষ্টি করে।
৩. বান্ডেল অব হিজ
এটি SA node থেকে উৎপন্ন হয়ে আন্তঃ নিলয় প্রাচীরের দিকে প্রবেশ করেছে। এই সংযোগী কলা কোষ টি মিনিটে প্রায় ৩৬ বার স্পন্দন প্রবাহ সৃষ্টি করে।
৪. পার্কিনজি ফাইবার/ তন্তু
এটি বান্ডেল অব হিজ থেকে উৎপন্ন হয়ে নিলয়ের প্যাপিলারি পেশীতে এবং নিলয়ের প্রাচীরে বিন্যস্ত হয়ে থাকে। মিনিটে প্রায় ৩০-৩৫ বার স্পন্দন সৃষ্টি করে।
হৃদপিন্ড এর প্রকোষ্ঠ
হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠ ৪ টি । যথা-
১. ডান অলিন্দ
২. ডান নিলয়
৩. বাম অলিন্দ
৪. বাম নিলয়
১. ডান অলিন্দ
আমাদের সারা দেহের সমগ্র দূষিত রক্ত ডান অলিন্দে প্রবেশ করে । ডান অলিন্দটি আবার সুপিরিওর ও ইনফিরিয়র ভেনাকাভার সঙ্গে যুক্ত থাকে ।
২. বাম অলিন্দ
এই বাম অলিন্দটি ফুসফুস হতে বিশুদ্ধ রক্ত গ্রহণ করে এবং একজোড়া ফুসফুসীয় শিরার মাধ্যমে তা বাম নিলয়ে পৌঁছায় ।
৩. ডান নিলয়
এটি ডান অলিন্দ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে এবং পরে তা ফুসফুসীয় ধমনির মাধ্যমে ফুসফুসে পৌছায়। নিলয়ের প্রাচীর সাধারণত পুরু হয় ।
৪. বাম নিলয়
এই বাম নিলয় বাম অলিন্দ হতে রক্তগ্রহণ করে । সেই রক্ত মহাধমনিতে প্রেরণ করে। সাধারণত এই বাম নিলয়ের প্রাচীর পুরু হয় ।
প্রকোষ্ঠের মধ্যকার পর্দা
৪ টি প্রকোষ্ঠের মাঝে রয়েছে এদের বিভক্তকারী ২ টি পর্দা। যথা-
১. আন্তঃ অলিন্দ পর্দা
এই পর্দা ডান ও বাম অলিন্দের প্রকোষ্ঠকে পরষ্পর থেকে পৃথক করে রাখে ।
২. আন্তঃনিলয় পর্দা
এই পর্দা ডান ও বাম নিলয়ের প্রকোষ্ঠকে পৃথক করে রাখে ।
এছাড়াও হৃদপিন্ডে রয়েছে-
ঊর্ধ্ব ও নিম্ন মহাশিরা–
সমগ্র দেহ থেকে যে রক্ত আসে সে রক্তকে ডান অলিন্দে প্রেরণ করে ।
ফুসফুসীয় শিরা
ফুসফুস থেকে যে রক্ত আসে সে রক্তকে বাম অলিন্দে প্রেরণ করে ।
ফুসফুসীয় ধমনি
এই ধমনী রক্তকে দক্ষিণ নিলয় থেকে ফুসফুসে পাঠায় ।
কপাটিকা ও ছিদ্র
১. দ্বিপত্র ও ত্রিপত্র কপাটিকা- এটি রক্তকে অলিন্দ থেকে নিলয়ে প্রেরণ করে কিন্তু নিলয় থেকে অলিন্দে আসতে বাধা প্রদান করে ।
২. অর্ধচন্দ্রাকার কপাটিকা- এটি নিলয় থেকে রক্ত মহাধমনি ও ফুসফুসীয় ধমনিতে প্রেরণ করে তবে বিপরীতমুখী হতে বাধা পায় ।মূলত রক্তের প্রবাহকে একমুখী রাখাই এদের প্রধান কাজ ।
৩. সেমিল্যুনার কপাটিকা
৪. থেবেসিয়াস কপাটিকা
৫. হ্যাভেরসিয়ান কপাটিকা
৬. ইউস্টেসিয়ান কপাটিকা
৭. ফোরামেন অব প্যানিজা
৮. ফোরামেন ওভেল
৯. ফসা ওভালিস ।
হৃদপিন্ড হলো পাম্পের ন্যায় ক্রিয়াশীল। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনকে বলা হয় হৃৎস্পন্দন । মানুষের হৃদপিন্ড সাধারণত 70-90 বার স্পন্দিত হয়ে থাকে । রেডিয়াল ধমনিতে যে হৃৎস্পন্দন শােনা যায় তাকে পালস বলা হয় । হৃৎপিণ্ডের একবার সংকোচন ও প্রসারণকে যথাক্রমে সিস্টোল ও ডায়াস্টোল বলে । স্টেথােস্কোপ নামক যন্ত্রের সাহায্যে হৃৎস্পন্দন গণনা করা যায় । ইঁদুরের হৃৎস্পন্দন প্রায় 100 / মিনিট , হাতির 28 / মিনিট । পুরুষের তুলনায় স্ত্রীলােকের হৃৎস্পন্দনের হার বেশি হয়ে থাকে।
মানুষের হৃদপিন্ডের মধ্য দিয়ে রক্ত সংবহন
মানব দেহের হৃদপিন্ড একটি ছন্দে সংকোচিত ও প্রসারিত হওয়ার মাধ্যমে সংবহন তন্ত্রের রক্ত কে সচল রাখে। হৃৎপিণ্ডের একবার সংকোচনকে সিস্টোল এবং এর একবার প্রসারন কে ডায়াস্টোল বলে। হৃৎপিণ্ডের একটি সিস্টোল ও একটি ডায়াস্টোল কে এক সঙ্গে একটি হৃৎস্পন্দন বলা হয়।
হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত কতগুলি কার্যে বিভক্ত –
১৷ অলিন্দদ্বয় প্রসারিত হলে সারা শরীরের দুষিত রক্ত ঊর্ধ্ব মহাশিরা দিয়ে ডান অলিন্দে আসে। একই সময় ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ রক্ত ফুসফুসীয় শিরার মাধ্যমে বাম অলিন্দ আসে।
২৷ অলিন্দ দ্বয় রক্ত দ্বরা পূর্ণ হলে সংকুচিত হয় এবং নিলয় দ্বয় প্রসারিত হয়। তখন ডান অলিন্দের রক্ত ত্রিপত্র কপাটিকার ভিতর দিয়ে ডান নিলয়ে পৌঁছায় এবং বাম অলিন্দের রক্ত দ্বিপত্র কপাটিকার ভিতর দিয়ে বাম নিলয়ের ভিতর প্রবেশ করে।
৩৷ নিলয় দ্বয় সম্পূর্ণ রক্ত দ্বরা পূর্ণ হলে সংকোচিত হয় এবং ডান নিলয় থেকে ফুসফুসীয় ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। বাম নিলয় থেকে মহা ধমনীর মাধ্যমে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় অর্ধচন্দ্রাকৃতি কপাটিকা খুলে যায় এবং তখন দ্বিপত্র ও ত্রিপত্র কপাটিকা বন্ধ হয়ে থাকে।
৪৷ এর পর আবার অলিন্দ দ্বয় প্রসারিত হওয়ার মাধ্যমে রক্ত অলিন্দে প্রবেশ করে। এইভাবে সংকোচন ও প্রসারনের মাধ্যমেই রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতিটি বজায় থাকে।
হৃদপিন্ডের কাজ
১. সারাদেহের প্রায় সকল কোষে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে থাকে।
২. পাম্পিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হরমোন ও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সারাদেহে সরবরাহ করে থাকে।
৩. দেহের দূষিত রক্ত এবং কোষের বিপাকীয় কাজের মাধ্যমে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থ ফুসফুসে প্রেরন করে।
৪. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখে ।
হৃদপিন্ড এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী নিম্নরূপ –
১। নাড়ির স্পন্দন প্রবাহিত হয় কিসের মধ্য দিয়ে ?
উত্তরঃ ধমনি
২। মানুষের হৃদপিন্ড কয় প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট ?
উত্তরঃ ৪ টি ।
৩। হৃদপিন্ড কোন ধরনের পেশি দ্বারা গঠিত ?
উত্তরঃ বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক দ্বারা ।
৪। একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির হৃদপিন্ডের ওজন কত ?
উত্তরঃ ৩০০ গ্রাম ।
৫। হৃদপিন্ডের ডায়াস্টোল বলতে কি বুঝায় ?
উত্তরঃ হৃদপিন্ডের প্রসারণ ।
৬। স্ট্রোক শরীরের কোন অংশে ঘটে ?
উত্তরঃ মতিষ্ক ।
৭। হৃদপিন্ডের গতি নির্ণয়কারী যন্ত্রের নাম কি ?
উত্তরঃ স্পিগমোম্যানোমিটার ।
৮। এনাজিওপ্লাস্টি কী?
উত্তরঃ হৃদপিন্ডের বন্ধ শিরা বেলুনের সাহায্যে ফুলানো ।
৯। রক্ত জমাট বাধার পর রক্তের পাতলা অবশিষ্ট অংশকে কী বলে ?
উত্তরঃ সিরাম ।
১০। SA Node মিনিটে কতোবার স্পন্দিত হয়?
উত্তরঃ ৭০-৮০ বার
১১। হৃদপিন্ড কাকে বলে–
উত্তরঃ রক্ত সংবহনতন্ত্রের যে অঙ্গটি পাম্পের মতো সংকোচন প্রসারনের মাধ্যমে সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করে তাকে হৃদপিন্ড বলা হয়৷
আশা করছি আপনাদের হৃদপিন্ড কাকে বলে এবং এই নিয়ে বিস্তারিত ধারনা দিতে পেরেছি। লিখাটি ভালো লেগে থাকলে নিজের বন্ধু বান্ধব ও পরিবারের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দিন। ধন্যবাদ।