মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এসব প্রথা বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তাদের কার্যাবলি সম্পন্ন করে সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করে। জনসমষ্টি এমন একটি বিষয়, যা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী, একই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এবং যাদের মধ্যে একতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ রয়েছে তাদেরকে জনসমষ্টি বলে। জনসমষ্টি জীবনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নানারকম কার্যাবলি সম্পন্ন করে থাকে।
জনসমষ্টি কি
সাধারণত একদল লোক যখন কতিপয় সাধারণ স্বার্থ ও অনুভূতি একই আচার ব্যবহার ও রীতিনীতিতে প্রণোদিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে, তখন তাকে জনসমষ্টি বলে।
বিভিন্ন সমাজকর্মী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে জনসমষ্টির সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে কতিপয় মনীষীর দেওয়া জনসমষ্টির সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল।
MacIver & Page তাঁদের ‘Society’ নামক গ্রন্থের ৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “যখন কোন ছোট বা বড় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা এমনভাবে বসবাস করে যে, তারা কোন বিশেষ স্বার্থের অংশীদার না হয়ে সাধারণ জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়ে অংশগ্রহণ করে, তখন সে গোষ্ঠীকে আমরা সমষ্টি বলে থাকি।”
অগবার্ন ও নিমকক্ষ তাঁদের ‘A Hand Book of Sociology‘ নামক গ্রন্থে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “সমষ্টি হল এমন একটি গোষ্ঠী বা কতকগুলো গোষ্ঠীর সমস্বয়ে যারা একটি নির্দিষ্ট লোকালয়ে বসবাস করে। সমষ্টির লোকেরা একই ভৌগোলিক এলাকায় বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে এমন একটি বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠে, যা অপরাপর গোষ্ঠী থেকে পৃথক করে রাখে।”
অগবার্ন ও নিমকফ, কিংসলে ডেভিস, পার্ক ও বার্জেস এরা সকলেই সম্প্রদায়কে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, জনসমষ্টিকে ব্যাপ্তভাবে ব্যবহার করলে আমরা দেখতে পাই যে, তা কোন অঞ্চলের সীমাবদ্ধতা বুঝায় না। যেমন- বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়, আমেরিকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরই একটি অংশ। জনসমষ্টি বা সম্প্রদায়ের সদস্যকে (স্থায়ীভাবে) সমাজের একটি অংশ জুড়ে বাস করতে দেখা যায় এবং সে একটি স্থান অধিকার করে থাকে। যেমন- যাযাবররাও বসবাস করার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয় নিয়ে থাকে, যদিও তাদের বাসস্থান অস্থায়ী।
জনসমষ্টির কার্যাবলি
নিম্নে জনসমষ্টির কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১. অর্থনৈতিক কাজ : জনসমষ্টির প্রথম ও প্রধান কাজ হল অর্থনৈতিক। জনসমষ্টি তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ করে। এ অর্থসংগ্রহ করতে গিয়ে তারা নানারকম পেশা গ্রহণ করে। জনসমষ্টিতে যেসব মহিলা থাকে তারাও আয়বর্ধনমূলক কাজ করে থাকে। আবার একটি জনসমষ্টির সবাই অর্থনৈতিক কাজের সাথে জড়িত থাকবে এমন নয়। তবে অর্থ আয় ও ব্যয়ের মাধ্যমে জীবনযাপন করা জনসমষ্টির একটি প্রধান কাজ।
২. মানবিক কার্যাবলি : একটি জনসমষ্টির লোকজন অর্থনৈতিক কার্যাবলির পাশাপাশি মানবিক কার্যাবলিও সম্পন্ন করে। জনসমষ্টির কেউ অসুস্থ হলে বা কোন বিপদে পড়লে অন্য সদস্যরা তাদের সহযোগিতা করে থাকে।
৩. ধর্মীয় কার্যাবলি : ধর্মীয় কার্যাবলি জনসমষ্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটি জনসমষ্টিতে বিভিন্ন ধর্মের লোক থাকতে পারে। আবার একই ধর্মের লোকও থাকতে পারে। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, উপাসনা ইত্যাদি তারা পালন করে। ধর্মীয় উপাসনার জন্য জনসমষ্টিতে ধর্মীয় উপাসনালয় থাকে। এছাড়াও ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
৪. পারিবারিক কার্যাবলি : জনসমষ্টিতে অনেক পরিবার বসবাস করে। এসব পরিবারের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ পারিবারিক কার্যাবলি সম্পন্ন করে থাকে। যেমন- পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া, তাদের অভাব অভিযোগ মিটানো, তাদের খোঁজখবর রাখা ইত্যাদি। এসব পারিবারিক কাজের মাধ্যমে জনসমষ্টির লোকজন তাদের জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখে।
৫. বৈবাহিক কার্যাবলি : জনসমষ্টিতে বৈবাহিক কার্যাবলিও সম্পন্ন হয়ে থাকে। জনসমষ্টিতে যারা বিয়ের উপযুক্ত তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হলেও জনসমষ্টির সদস্যরা বিয়ের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিয়েতে সাহায্য করে। দাওয়াত করে সমষ্টির সবাইকে খাওয়ায়। সমষ্টির লোকজনও উপহার সামগ্রী দেয়। বর্তমানে শহরে বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
৬. শিক্ষামূলক কাজ : শিক্ষামূলক কাজ জনসমষ্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জনসমষ্টির সদস্যরা যাতে উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ করে যেসব শিশু রয়েছে তাদের শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। বড়দের জন্য বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। তবে যাহোক, জনসমষ্টির সদস্যদের শিক্ষিত করে তোলা জনসমষ্টির খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।