শব্দ কি? শব্দের সংজ্ঞা। শব্দের শ্রেণীবিভাগ।

শব্দ কি?
যে কোনো অর্থ প্রকাশক ধ্বনি বা আওয়াজই হল শব্দ। যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির অর্থ নেই তা শব্দ নয়। কতকগুলো ধ্বনি পরস্পর মিলিত হয়ে একটি অর্থ প্রকাশ করলে সেটি হয় শব্দ৷

অর্থাৎ যখন এক বা একাধিক ধ্বনির সাহায্যে মনের ভাব কিংবা একটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা হয়, তখন তা-ই শব্দ বলে চিহ্নিত হয়।

শব্দের সংজ্ঞাঃ মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকে শব্দ বলে।

অথবা, অর্থবোধক একটি ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ বলে।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে— “অর্থ বিশিষ্ট ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ বলে।”

ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে— “কোনো বিশেষ সমাজের নর-নারীর কাছে যে ধ্বনির স্পষ্ট অর্থ আছে, সেই অর্থযুক্ত ধ্বনি হচ্ছে সেই সমাজের নর-নারীর ভাষার শব্দ।” যেমন– মা, মামা, আম, মিষ্টি ইত্যাদি।

শব্দের শ্রেণীবিভাগ
বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যথা—

১। উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ।
২। গঠন প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ।
৩। অর্থভেদে শ্রেণীবিভাগ।

১। উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ

বাংলা ভাষায় যে সমস্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেগুলো সবই খাঁটি বাংলা শব্দ নয়। বাংলা ভাষা একটি সংকর বা মিশ্র ভাষা। বাংলা ভাষায় বিচিত্র রকমের শব্দের সমাবেশ হয়েছে। এ শব্দগুলো নানাভাবে বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। ভাষাতত্ত্বমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দের উৎস বা উৎপত্তির মূল বিচারে এদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। যথা— (১) তৎসম শব্দ, (২) অর্ধ-তৎসম শব্দ, (৩) তদ্ভব শব্দ, (৪) দেশি শব্দ ও (৫) বিদেশি শব্দ।

১। তৎসম শব্দঃ যে সকল শব্দ অবিকৃত অবস্থায় সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে সেগুলোকে তৎসম শব্দ বলা হয়। সংস্কৃত ‘তৎ’ অর্থ তার এবং ‘সম’ অর্থ সমান।

অতএব, ‘তৎসম’ শব্দের অর্থ তার সমান। তৎসম শব্দটি সংস্কৃত অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। যেমন– সূর্য, চন্দ্ৰ, পৃথিবী, মুনি, নদী, আকাশ, হস্ত ইত্যাদি।

২। অর্ধ-তৎসম শব্দঃ যেসকল সংস্কৃত শব্দ সামান্য পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে সেগুলোকে অর্ধ-তৎসম শব্দ বলে। যেমন—

জ্যোৎস্না (সংস্কৃত) > জোছনা (বাংলা);
গৃহিণী (সংস্কৃত) > গিন্নী (বাংলা);
মহাশয় (সংস্কৃত) > মশায়/মশাই (বাংলা);
নিমন্ত্রণ (সংস্কৃত) > নেমতন্ন (বাংলা) ইত্যাদি।

৩। তদ্ভব শব্দঃ যে সকল সংস্কৃত শব্দ প্রাকৃতের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে, তাদের বলা হয় তদ্ভব শব্দ। [‘তৎ’ অর্থ তার (সংস্কৃত), ‘ভব’ অর্থ উদ্ভূত বা ‘জাত’। সংস্কৃত থেকে জন্ম যার, তা তদ্ভব।] যেমন–

চন্দ্র (সংস্কৃত) > চন্দ (প্রাকৃত) > চাঁদ (বাংলা);
ভক্ত (সংস্কৃত) > ভত্ত (প্রাকৃত) > ভাত (বাংলা);
পাদ (সংস্কৃত) > পাঅ (প্রাকৃত) > পা (বাংলা);
কার্য (সংস্কৃত) > কজ্জ (প্রাকৃত) > কাজ (বাংলা);
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের শতকরা প্রায় ষাট ভাগ শব্দই তদ্ভব।

৪। দেশি শব্দঃ অতি প্রাচীন কালে বাংলাদেশে যে সকল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতি বাস করত, সকল আদি অধিবাসীদের ব্যবহৃত যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে, তাদের দেশি শব্দ বলে। যেমন— ডাব, ডিঙি, ঝাঁটা, ঢাল, ঝিঙা, কুলা ইত্যাদি।

৫। বিদেশি শব্দঃ আরবি, ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে, সেগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন—

  • আরবিঃ ঈমান, মসজিদ, আযান, ওযু, ঈদ, হুকুম, আসল, নকল ইত্যাদি।
  • ফারসিঃ রোযা, নামায, শাদী, উজির, বাজার, দালাল, দরজা, লেপ, চশমা ইত্যাদি।
  • ফরাসিঃ কুপন, কার্তুজ, ওলন্দাজ, রেস্তোরা ইত্যাদি।
  • পর্তুগিজঃ পেঁপে, পিস্তল, বোমা, বোতাম, বালতি, গারদ, কেরানি, আনারস, সাবান, আয়া ইত্যাদি
  • ইংরেজিঃ চেয়ার, টেবিল, রেডিও, টেলিভিশন, স্কুল, কলেজ, ভোট, চেয়ারম্যান, ব্যাংক, বোর্ড, হাসপাতাল,
  • মাস্টার, মাইল, ফুটবল, ফোন ইত্যাদি।

২। গঠন প্রকৃতি অনুসারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ

গঠন প্রকৃতি অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে দু ভাগে ভাগ করা যায় । যথা— (১) মৌলিক শব্দ ও (২) সাধিত শব্দ।

১। মৌলিক শব্দঃ যে সকল শব্দের উৎপত্তির কারণ জানা সম্ভব হয় নি কিংবা যে সকল শব্দকে ভাঙা বা বিশ্লেষণ করে দেখানো যায় না, তাদের বলা হয় মৌলিক শব্দ। যেমন — বাবা, মা, পাঁচ, ধন, সাপ ইত্যাদি।

২। সাধিত শব্দঃ যে সকল শব্দকে বিচ্ছিন্ন করা যায় অথবা মৌলিক শব্দের সঙ্গে বিভক্তি, প্রত্যয়, অনুসর্গ, উপসর্গ বা অন্য কোনো মৌলিক শব্দযুক্ত হয়, তাদের সাধিত শব্দ বলে। সাধিত শব্দের পৃথক অংশের প্রত্যেকটির আলাদা অর্থ পাওয়া যায়। যেমন— ঢাকা + য় = ঢাকা (বিভক্তি যোগে), অপ + মান = অপমান (উপসর্গ যোগে), তোমা + হতে = তোমা হতে (অনুসর্গ যোগে), খা + ওয়া = খাওয়া (প্রত্যয় যোগে), ষোল + কলা = ষোলকলা (অন্য শব্দ যোগে) ইত্যাদি।

সাধিত শব্দগুলো আবার দু ভাগে বিভক্ত। যথা—

(ক) প্রত্যয়নিষ্পন্ন শব্দ ও (খ) সমাসবদ্ধ বা যুক্ত শব্দ।

(ক) প্রত্যয়নিষ্পন্ন শব্দঃ যে সকল শব্দকে ভাঙলে দুটি অংশ পাওয়া যায়, একটি অংশ মূল শব্দ বা ধাতু (ক্রিয়ার মূল) অন্যটি প্রত্যয়, তাদের প্রত্যয়নিষ্পন্ন সাধিত শব্দ বলে। যেমন— চোর + আই = চোরাই, খেল্ + না খেলনা ইত্যাদি।

(খ) সমাসবদ্ধ শব্দঃ যে সকল শব্দ একাধিক মৌলিক বা সাধিত শব্দ যোগে গঠিত হয়, তাদের সমাসবদ্ধ শব্দ বলে। অর্থাৎ শব্দের সাথে শব্দের সংযোগের ফলে যুক্ত শব্দ সাধিত হয়। যেমন— মুখচ্ছবি, সিংহাসন ইত্যাদি।

৩। অর্থভেদে শব্দের শ্রেণীবিভাগ

বাংলা ভাষায় অর্থের বিচারে শব্দগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— (১) যৌগিক শব্দ, (২) রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ ও (৩) যোগরূঢ় শব্দ।

১। যৌগিক শব্দঃ প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের সাহায্যে যে সকল শব্দের অর্থ নির্ণয় করা যায়, তাদের যৌগিক শব্দ বলা হয়। যেমন — স্বর্ণ + কার = স্বর্ণকার; কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার।

২। রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দঃ কোনো বিশেষ অর্থ নির্দেশ করার জন্য যে সকল শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাদের রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলা হয়। যেমন- পাঞ্জাবি, শত্রু, মিত্র, ধোলাই ইত্যাদি।

  • পাঞ্জাবি – পাঞ্জাবের অধিবাসী। বিশেষ অর্থে – এক প্রকার জামা (যা পাঞ্জাবের অধিবাসীরা পরে)।
  • শত্রু – হিংসা করে যে। বিশেষ অর্থে – অরি।
  • মিত্র – স্নেহ করে যে। বিশেষ অর্থে – বন্ধু।
  • ধোলাই – ধোওয়া। বিশেষ অর্থে- প্রহার

৩। যোগরূঢ় শব্দঃ যে সকল শব্দ প্রকৃতি ও প্রত্যয় থেকে জাত অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোনো অর্থ প্রকাশ করে থাকে, তাদের যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন— দশ আনন যার = দশানন, আশীতে বিষ যার = আশীবিষ, পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ ইত্যাদি। ‘দশানন’ অর্থ রাবণ। ‘আশীবিষ’ অর্থ সাপ। ‘পঙ্কজ’ অর্থ পদ্ম।

অনুশীলনী

  • শব্দ কাকে বলে? বাংলায় শব্দ কয় প্রকার ও কী কী? উদাহরণসহ লেখ।
  • তৎসম শব্দ বলতে কী বোঝ? কয়েকটি তৎসম শব্দের উদাহরণ দাও।
  • তদ্ভব শব্দ কাকে বলে? উদাহরণসহ লেখ।
  • উৎপত্তি অনুসারে বাংলা শব্দকে কয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং কী কী? প্রত্যেক প্রকারের একটি করে উদাহরণ দাও।
  • অর্থ অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে কয় ভাগে বিভক্ত করা যায়? তাদের নাম বল ও প্রত্যেকটির একটি করে উদাহরণ দাও।
  • তৎসম ও তদ্ভব শব্দের পার্থক্য উদাহরণসহ লেখ।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তর

১। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে কয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে?
অথবা, উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দসমূকে কয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়?
ক) পাঁচ ভাগে
খ) ছয় ভাগে
গ) সাত ভাগে
ঘ) আট ভাগে
সঠিক উত্তর : ক) পাঁচ ভাগে

২। দুই বা ততোধিক বর্ণ দিয়ে অর্থবোধক যা সৃষ্টি হয় তার নাম কী?
ক) ভাষা
খ) শব্দ
গ) সন্ধি
ঘ) বাক্য
সঠিক উত্তর : খ) শব্দ

৩। যে-সব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে সে-সব শব্দকে কী বলা হয়?
অথবা, সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত অপরিবর্তনীয় শব্দসমূহের নাম কী?
ক) অর্ধ-তৎসম
খ) দেশি শব্দ
গ) তদ্ভব শব্দ
ঘ) তৎসম শব্দ
সঠিক উত্তর : ঘ) তৎসম শব্দ

৪। ‘তৎ’ শব্দ দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
ক) সংস্কৃত ভাষাকে
খ) প্রাকৃত ভাষাকে
গ) আরবি ভাষাকে
ঘ) উর্দু ভাষাকে
সঠিক উত্তর : ক) সংস্কৃত ভাষাকে

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *