বিটকয়েন কি এবং কিভাবে কাজ করে? What is a Bitcoin and how does it work?
বিটকয়েন (Bitcoin) এর নাম শুনেনি, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। স্বভাবতই বিটকয়েন সম্পর্কে আমাদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। এই আর্টিকেলে আমরা বিটকয়েন এর আদ্যোপান্ত জানবো। আর্টিকেলটি পড়ে জানতে পারবেনঃ
- বিটকয়েন কি? (What is a Bitcoin?)
- বিটকয়েন এর মূল্য (Price of Bitcoin)
- বিটকয়েন কে তৈরি করেন? (Who Invented Bitcoin?)
- বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে? (How does Bitcoin work?)
- বিটকয়েন এর সুবিধা ও অসুবিধা (Advantages and disadvantages of Bitcoin)
- বিটকয়েন ও প্রচলিত অর্থের পার্থক্য
বিটকয়েন কি? (What is a Bitcoin?)
বিটকয়েন একটি ক্রিপটোকারেন্সি, যা সাতোশি নাকামোতো নামের একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি (বা একাধিক ব্যক্তির একটি দল) ২০০৮সালে তৈরি করেন। ২০০৯ সালে এর প্রচলন শুরু হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিটকয়েন হচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রা যা দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পিয়ার-টু-পিয়ার (peer-to-peer) ট্রানজেকশন করা যায়।
পেপাল বা পেওনিয়ার এর মতো সার্ভিসগুলো প্রথাগত উপায় অনুসরণ করে ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড/পেমেন্ট নেটওয়ার্কের সাহায্যে অর্থ লেনদেন করে। অন্যদিকে বিটকয়েন হলো ডিসেন্ট্রালাইজড অর্থ, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকেউ কোনো বাধাধরা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই আদান প্রদান করতে পারে।
বিটকয়েন এর মাধ্যমে হওয়া প্রতিটি লেনদেন ব্লকচেইনে লিখিত থাকে, যা অনেকটা ব্যাংকের খতিয়ানের মত কাজ করে। মূলত এটি বিটকয়েন দ্বারা ঘটিত সকল লেনদেনের একটি রেকর্ডস্বরুপ।
বিটকয়েন ব্লকচেইন এর তথ্য সমস্ত নেটওয়ার্ক জুড়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকে। কোনো প্রতিষ্ঠান, দেশ বা থার্ড পার্টি এটি নিয়ন্ত্রণ করেনা, এবং যেকেউ এর অংশ হতে পারে।
বিটকয়েন এর সাপ্লাই কিন্তু নির্দিষ্ট। সব মিলিয়ে মাত্র ২১মিলিয়ন বিটকয়েন রয়েছে। এই অংকের চেয়ে বেশি মাত্রার বিটকয়েন তৈরি বা উৎপাদন সম্ভব নয়। সকল বিটকয়েন ব্যবহারকারী এই অর্থ ভাগাভাগি করেন। যদিও এখনো বিটকয়নের এই পুরো পরিমাণ সংগ্রহ করা হয়নি।
বিটকয়েন এর মূল্য (Price of Bitcoin)
বিটকয়েন এর মূল্য সবসময় ওঠানামা করতে থাকে। যেকোনো ক্রিপটোকারেন্সির দাম একইভাবে ওঠানামা করে। যার ফলে এক বিটকয়েনে কত টাকা, কত টাকায় এক বিটকয়েন, এক বিটকয়েন কত টাকার সমান – এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন।
সর্বশেষ তথ্য অনুসারে এক বিটকয়েন এর মূল্য বর্তমানে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। আমরা আগেই জেনেছি বিটকয়েন এর দাম নির্দিষ্ট থাকেনা, সবসময় ওঠানামা করতে থাকে। BTC বা Bitcoin লিখে গুগলে সার্চ করে খুব সহজে বিটকয়েন এর বর্তমান দাম জানতে পারবেন।
বিটকয়েন কে তৈরি করেন? (Who Invented Bitcoin?)
বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে – তা জানার আগে এটি তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরি। যদিওবা বিটকয়েন এর সৃষ্টিকর্তা নিয়ে অনেক খোঁজ চালানো হয়েছে, তবুও কে বা কারা বিটকয়েন তৈরি করেছেন তার পরিচয় অজানা থেকে গিয়েছে।
২০০৮সালে অনলাইনে প্রকাশিত একটি হোয়াইট পেপারে প্রথম বিটকয়েন প্রযুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। সাতোশি নাকামোতো নামের কোনো এক ব্যক্তি বা গ্রুপ এই তথ্য অনলাইনে পোস্ট করে।
উক্ত হোয়াইট পেপারে শুধুমাত্র ক্রিপটোগ্রাফি ও কম্পিউটার সাইন্স নয়, বরং কিভাবে ডিজিটালি পরিচয় গোপন রেখে অর্থ বা তথ্য আদানপ্রদান করা যার, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য দেওয়া ছিলা।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং বিটকয়েন ছিলো কম্পিউটার সাইন্সের একটি নতুন অধ্যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থ আদান প্রদানের নতুন একটি জগতের সৃষ্টি করে এটি। অর্থ আদান-প্রদানে ব্যাংক এর মত থার্ড পার্টির প্রয়োজন ঘুচিয়ে দেয় বিটকয়েন এর প্রযুক্তি।
বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে? (How does Bitcoin work?)
ভিসা এর মতো পেমেন্ট নেটওয়ার্ক বা পেপাল এর মতো পেমেন্ট সার্ভিসের মতো প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ করেনা বিটকয়েন। বিটকয়েন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিশ্বের প্রথম মুক্ত পেমেন্ট নেটওয়ার্ক হলো বিটকয়েন, যেখানে যেকেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। বিটকয়েন তৈরির পেছনে প্রধান উদ্দ্যেশই ছিলো ইন্টারনেট ব্যবহার করে একটি ডিসেন্ট্রালাইজড পেমেন্ট ব্যবস্থা তৈরি করা।
বিটকয়েন এর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ব্লকচেইন যা এর আদান-প্রদানের হিসাব রাখে। তবে বিটকয়েন ডিসেন্ট্রালাইজড হওয়ায় যেকেউ লেনদেনের তথ্য দেখতে পারে ও কেউ এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।
চলুন আরো ভালোভাবে জানা যাক কিভাবে বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে।
“মাইনিং রিগ” নামে পরিচিত স্পেশাল কম্পিউটার প্রতিটি লেনদেনের তথ্য রেকর্ড ও ভেরিফাই করে। প্রথমদিকে সাধারণ যেকোনো কম্পিউটার ব্যবহার করেই বিটকয়েন মাইনিং করা যেতো। তবে বর্তমানে বিটকয়েন মাইন করতে অনেক শক্তিশালী কম্পিউটারের প্রয়োজন হয়। ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালের বিটকয়েন এর চেয়ে বর্তমানে বিটকয়েন মাইনিং করতে ১২ ট্রিলিয়ন গুণ কম্পিউটিং পাওয়ার প্রয়োজন।
মূলত কম্পিউটিং পাওয়ার ব্যবহার করে মাইনিং এর মাধ্যমে বিটকয়েন মাইন করা যায়। বিটকয়েন মাইনিংকে অনেকটা লটারি বা রেসের সাথে তুলনা করা যায়। মূলত বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে যেকেউ উক্ত রেস বা লটারির পুরস্কার পেতে পারে। এখানে পুরস্কার হলো বিটকয়েন। প্রতি লেনদেনে মাইনিং এর এই পুরস্কার পরিবর্তন হতে থাকে।
বিটকয়েন লেনদেনে সহায়তা করার জন্য এসব মাইনিং কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। যারা এই কম্পিউটারগুলোর মালিক তাদেরকে বিটকয়েন মাইনার বলা হয়। বিটকয়েন লেনদেনে সহায়তা করার পুরস্কারস্বরূপ তারা বিটকয়েন পেয়ে থাকে। তবে বর্তমানে এরকম বিটকয়েন মাইনিং আর আগের মত লাভজনক নেই।
প্রথমদিকে বিটকয়েন এর কোনো মূল্যই ছিলোনা। ২০১৮ সালে এসে এক বিটকয়েন এর মূল্য প্রায় ৭,৫০০ডলার ছিলো। তবে বিটকয়েন এর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিটকয়েন কিনতে হয়না। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংকের বিটকয়েন এর মালিক হওয়া সম্ভব।
বিটকয়েন এর ক্ষুদ্রতর অংশকে সাতোশি বলা হয়। ১০০ মিলিয়ন সাতোশি মিলে তৈরি হয় এক বিটকয়েন। সাতোশি নাকামোতো এমনভাবে বিটকয়েন এর নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন, যাতে ২১ মিলিয়নের অধিক বিটকয়েন মাইন করা সম্ভব না হয়। বর্তমানে মাইন করার মত প্রায় ৩মিলিয়ন বিটকয়েন অবশিষ্ট রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২১৪০ সালের মধ্যে সকল বিটকয়েন মাইন করা হয়ে যাবে।
বিটকয়েন এর সুবিধা (Advantages of Bitcoin)
বিটকয়েন অনেকটা প্রচলিত ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড এর মত ব্যবহার করা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড ইনফো প্রদানের বদলে বিটকয়েনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাবলিক কি ও পেমেন্ট এমাউন্ট প্রদান করতে হয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিটকয়েন এর কিছু সুবিধাসমূহ সম্পর্কে।
- বিটকয়েন একটি জনপ্রিয় অর্থব্যবস্থা, যার ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশে যেকোনো সময় কোনো বাড়তি ফি ছাড়া বিটকয়েন ব্যবহার সম্ভব
- বিটকয়েন ডিসেন্ট্রালাইজড হওয়ায় আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া তৎক্ষনাৎ ঘটে। চিরাচরিত ক্রেডিট কার্ড এর মত বিটকয়েনের ক্ষেত্রে ট্রানজেকশন ডাটা রেকর্ড হতে সময় লাগেনা
- বিটকয়েন ওপেন সোর্স প্রযুক্তি হওয়ায় যেকেউ লেনদেনের তথ্য দেখতে পারে, যার ফলে অর্থ ম্যানিপুলেশন এর কোনো সুযোগ নেই
- বিটকয়েন প্রযুক্তি অত্যন্ত নিরাপদ যা হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব বলা চলে
বিটকয়েন এর অসুবিধা (Disadvantages of Bitcoin)
বিটকয়েন যেহেতু ছদ্মনামে এবং কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষের অগোচরেই লেনদেন করা সম্ভব তাই এটি ব্যবহার করে কোনো বেআইনি লেনদেন হলে সেটা নির্ণয় করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়না। কিন্তু সাধারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হলে সহজেই দাতা ও গ্রহীতাকে সনাক্ত করা যায়। এজন্য বিটকয়েনের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিটকয়েন বা অন্য কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি স্বীকৃতি পায়নি। তাই বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি পাওয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে এ ধরণের ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন না করাই ভাল।
বিটকয়েন ও প্রচলিত অর্থের পার্থক্য
বিটকয়েন ও প্রচলিত অর্থের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত অর্থ সাধারণত কোনো দেশের সরকার কতৃক ইস্যু করা হয়। অন্যদিকে বিটকয়েন হলো কম্পিউটারের মাধ্যমে ওপেন সোর্স কোড ব্যবহার করে চালিত একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা।
প্রচলিত অর্থের মূল্য বা দাম ঠিক করে উক্ত অর্থ পরিচালনাকারী সরকার। অন্যদিকে বিটকয়েন এর দাম এর দাম এর সাপ্লাই ও ডিমান্ড এর উপর নির্ভরশীল।
প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় শুধুমাত্র সরকার ও ব্যাংক সংযুক্ত থাকে। অন্যকেউ এই অর্থ সম্পর্কে জানতে পারেনা। তবে সরকার বা ব্যাংক কতৃপক্ষ যেকোনো সময় এই অর্থ নিয়ে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম। অন্যদিকে বিটকয়েন দ্বারা করা সকল ট্রানজেকশন সম্পূর্ণ মুক্তভাবে ইন্টারনেটে বিচরণ করে, যা যেকেউ দেখতে পারে।
সাধারণ অর্থের ক্ষেত্রে ফিজিক্যাল মুদ্রা বা টাকা থাকলেও বিটকয়েন এর ক্ষেত্রে কোনো ফিজিক্যাল কয়েন নেই। আবার বিশ্বের সকল দেশে প্রচলিত অর্থ কেনাকাটা করতে ব্যবহার করা গেলেও বিটকয়েন এর ব্যবহার এখনো সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
বিটকয়েন সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর
বিটকয়েন কি বাংলাদেশে বৈধ?
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিটকয়েন আইনীভাবে স্বীকৃতি বা বৈধতা পায়নি। তাই বলা যায় বাংলাদেশে থেকে বিটকয়েন ব্যবহার না করাই ভাল।
বিটিসি (BTC) কি?
বিটকয়েন (Bitcoin) এর সংক্ষিপ্ত রুপ হলো বিটিসি।
বিটকয়েন কি ক্রিপটোকারেন্সি?
হ্যাঁ, বিটকয়েন হলো সর্বাধিক সমাদৃত ক্রিপটোকারেন্সি।
বিটকয়েন থেকে আয় সম্ভব কি?
যেসব দেশে বিটকয়েন বৈধ সেসব দেশে থেকে অন্যসব সম্পদের মতো বিটকয়েন কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির মাধ্যমে অর্থ আয় সম্ভব।