জমি দখলকারীর হাতে ১৮ বছর জিম্মি দেশের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী

এক জমি দখলদারের হাতে ১৮ বছর ধরে জিম্মি হয়ে আছেন দেশের প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক। রাজশাহী মহানগরীর সাগরপাড়া এলাকায় তার বাড়ির একটি অংশ কিছুতেই দখলমুক্ত করতে পারছেন না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমিরেটাস অধ্যাপক। কয়েক দফায় দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ে জিতলেও তিনি ফিরে পাননি তার জায়গা।

‘বিদেশে থাকার সুযোগ ছিল। থাকিনি, বুঝলে। দেশের জন্য কিছু করবো বলেই ফিরেছি। নিজের কথা বলতে চাই না। কিন্তু এদেশটা এমন হতে দেয়া যায় না। সে কারণেই এটুকু বললাম। আর তুমি যা জানতে চাইছো, তা নিয়ে আমি ক্যামেরার সামনে কোনো কথাই বলতে চাই না।’ মঙ্গলবার (২৮ জুন) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নিজের গবেষণাগারে বসে প্রায় তিন ঘণ্টার আলাপচারিতায় অনেক কথা বললেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অরুণ ‍কুমার বসাক। কিন্তু জমি দখল নিয়ে কথা তুলতেই বলে উঠলেন, এসব নিয়ে মিডিয়ায় কোনো আলাপ নয়, আমি দেখতে চাই রাষ্ট্র কী করে।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) কাছে বিজ্ঞান একাডেমির স্বর্ণপদকজয়ী এ পদার্থবিদ অভিযোগ দিলেও আরডিএও এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অভিযোগসূত্রে জানা যায়, নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় তার বাড়িটি স্ত্রী দেবিকা বসাকের নামে। তার মৃত্যুর পর এই সম্পত্তির মালিক হন নিঃসন্তান অধ্যাপক বসাক। সাগরপাড়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লি স্থানীয় প্রভাবশালী ইয়াহিয়া ফেরদৌস ২০০৪ সালে পাশের জমিতে তার বাড়ি তৈরির সময় অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে কয়েক ফুট জায়গা দখল করে নেন। এ নিয়ে আরডিএতে অভিযোগ দিলেও তারা ইয়াহিয়াকে নোটিশ পাঠান চার বছর পর ২০০৮ সালে। ততদিনে জায়গা দখল করে তার বাড়ি তৈরি সম্পন্ন হয়েছে।

এরপর ইয়াহিয়া আরডিএর ওই আদেশ রহিত করার জন্য আদালতে মামলা করেন। এছাড়া অধ্যাপক বসাক দম্পতির বিরুদ্ধে ওয়াকফ এস্টেটের জমি দখলের মিথ্যা অভিযোগ আনেন। পরবর্তীতে কয়েক ধাপে আদালতে ইয়াহিয়ার অভিযোগগুলো সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিন্তু আদালতের রায়ের পরেও দখল ছাড়েননি ইয়াহিয়া।

অশীতিপর অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক আফসোসের সুরে বলেন, আমি এখনও দিনরাত আমার গবেষণা আর কাজ নিয়েই থাকি। জমিজমার ব্যাপারে আমার কখনওই কোনো বিশেষ মনোযোগ ছিলো না। আমার স্ত্রীই এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু এই দুশ্চিন্তায় তিনিও অসুস্থ্য হয়ে গত হলেন। তারপরেও এর সুরাহা হলো না।

অধ্যাপক বসাক অভিযোগ করেন, ওই দখলদার তাকে রাস্তা আটকে হুমকিও দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে ধরে (দখলদার) বললো যে আমি দখল না ছাড়লে আপনি কী করবেন? আমার যে লোকজন আছে ওদের বলে আপনাকে শায়েস্তা করবো। তখন আমি বললাম, আমি আর কী করতে পারি? আমার তো আর ওসব কিছু নেই। কিন্তু আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আছে। ওদের শিক্ষক হিসেবে সারাজীবন শিখিয়েছি অন্যায় মেনে না নিতে। সেটাই ওরা করবে।

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ইয়াহিয়া ফেরদৌস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি দাবি করেন, আদালতের রায় অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন।

আরডিএ অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি দাবি করেন, বিষয়টি এখন আদালতের এখতিয়ারে। আদালত নির্দেশ দিলেই তারা ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ষাটের দশকের মেধাবী প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি। ১৯৬৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দেশের বাইরে বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষা ও গবেষণায় ভূমিকা রেখেছেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। বিজ্ঞান একাডেমি পুরস্কারজয়ী এই বিজ্ঞানী তার নিউক্লীয় তত্ত্বের জন্য বিশ্বে সুপরিচিত।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *