রাজনৈতিক দল বলতে কি বুঝ? রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে লেখ।
বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক দল রয়েছে। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক দেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দল রয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরোধা প্লেটো ও এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত বিকাশ ঘটেছে। রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা : সাধারণভাবে রাজনৈতিক দল বলতে এমন একটি গোষ্ঠীকে বুঝায় যাদের মোটামুটিভাবে একটি সংগঠিত দল রয়েছে যেটি ভোটদানের মাধ্যমে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করার মাধ্যমে সরকারি ক্ষমতা এজন্য তৎপর থাকে।
যখন সংগঠিত কিছু জনসমষ্টি তাদের নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বা উদ্দেশ্যমণ্ডিত হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে তাকে রাজনৈতিক দল বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা নিম্নে দেওয়া হলো
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুম্পিটার-এর মতে, “রাজনৈতিক দল এমন এক গোষ্ঠী বিশেষ, যার সদস্যরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রামে একযোগে কাজ করে যেতে পারে।”
ম্যাকাইভার বলেন, “রাজনৈতিক দল বলতে সেই জনসমষ্টিকে বুঝায় যারা বিশিষ্ট এক কার্যনীতির ভিত্তিতে একত্রিত ও সুসংহত হয়েছে এবং যারা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠনে প্রয়াসী হয়।”
গেটেল বলেন, “রাজনৈতিক দল বলতে মোটামুটিভাবে সংগঠিত এমন একটি সামরিক সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা একটি রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে এবং যারা ভোটদানের মাধ্যমে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি : রাষ্ট্রচিন্তা থেকে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা তথা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা থেকে রাজনৈতিক পিটার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। প্লেটো গণতন্ত্রের বিপক্ষে বলেছেন।
আবার আর্টশ রাষ্ট্রচিন্তার রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস, এরিস্টটল রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ করেছেন। রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা এসেছে- বিংশ শতাব্দী পঞ্চম দশক থেকে।
রাজনৈতিক দলের ক্রমবিকাশ : বিশেষ রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে।
১. নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অভাব : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সামাজিক ভিত্তি বা আদর্শগত বিচারের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। উভয় দলই সমাজতন্ত্রের বিরোধী এক ধনতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত দল দু’টির মধ্যে অনুপস্থিত।
২. সঙ্গীয় সমর্থনের ভিত্তিহীনতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ভোটারদের ভোটদানের প্রবণতা প্রবল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো দলের বিজয়কে সুনিশ্চিত করার জন্য ঐ দলকে সমর্থন করার স্থায়ী ভিত্তি নেই।
৩. বিকেন্দ্রীভূত দলীয় সংগঠন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্রী এ দুটি বৃহৎ দলের সংগঠন বিকেন্দ্রীভূত। উত্তর দলই হলো কার্যত অঙ্গরাজ্যের দল বা আঞ্চলিক দল। কোনো দলের কোনো জাতীয় নেতা রাজ্যে দলের নীতি বা মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করতে পারেন না।
৪. দলীয় শৃঙ্খলা : ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। শৃঙ্খলাবোধ দিল ব্যবস্থার অন্যতম সাংগঠনিক ভিত্তি হিসেবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রত্যেক দলের কেন্দ্রীয় সংগঠনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হয় ।
৫. সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার গঠনই লক্ষ্য: ব্রিটেনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজনৈতিক তথা সরকারি ক্ষমতা দখল করতে চায়। কোনো দলই ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে অসাংবিধানিক পদ্ধতিকে সমর্থন করে না।
৬. আধুনিক বৃহদায়তনের জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা : প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল বলে | সবাই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় যে, বৃহৎ পরিসর ও বৃহৎ আয়তনের কারণে জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
৭. সংসদীয় ঐতিহ্যের অভাব : ফরাসি দলীয় ব্যবস্থায় সংসদীয় ঐতিহ্যের অভাব লক্ষ করা যায়। ফরাসি রাজনৈতিক দলগুলো পার্লামেন্টের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। বহুদলীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধার এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই।
৮. স্থায়িত্বের অভাব : পরিবর্তনশীলতা ফ্রান্সের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ফ্রান্সের নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং অল্প কালের ব্যবধানে এই সকল দলের অবলুপ্তির ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। অর্থাৎ ফ্রান্সের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্থায়িত্বের অভাব লক্ষ করা যায়।
৯. ভারতীয় দলীয় ব্যবস্থা : ভারতের দলীয় ব্যবস্থা বহুদলীয় ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ দলগুলোর মধ্যে সামাজিক রাজনৈতিক ভিত্তি সাংগঠনিক কাঠামো কর্মসূচি এবং কর্মপরিচালনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। ভারতে জাত- পাত, উপজাতি, ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক অসংখ্য দল গঠিত হয়েছে।
১০. বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোই জনগণের মধ্যে চেতনা জাগ্রত করে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে বহুদল ব্যবস্থা বিদ্যমান ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর . উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দীর্ঘ ক্রমবিবর্তনের ফলে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পর বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলো আজ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
আরো জানুন জনমত গঠনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কী কী?
শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “রাজনৈতিক দল কী? রাজনৈতিক ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।