National University

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস ৬৬% শিক্ষার্থীই এখন বেকার

1 min read

রাজু আহমেদ নোয়াখালী সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে। অনার্স (সম্মান) শেষ হওয়ার পর থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করেন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁর পড়াশোনা শেষ হয়। টানা চার বছর চেষ্টা করেও চাকরি নামের সোনার হরিণ জোটেনি রাজুর কপালে। জীবিকার তাগিদে শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের শুরুর দিকে পাড়ি জমান সৌদি আরবে।

একই কলেজে একই শিক্ষাবর্ষে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন নুরে আলম। তিনিও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও কোনো চাকরি পাননি। এখন টিউশনি করে কোনোমতে চলছেন।

রাজু ও নুরে আলমের মতো সারা দেশে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখনো চাকরি পাননি। তাই অনন্যোপায় হয়ে কেউ বিদেশে চলে যাচ্ছেন, কেউবা ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছোটখাটো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন।

২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।

বিআইডিএস বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে যাঁরা বেকার থাকছেন, তাঁদের অধিকাংশই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করা। অর্থাৎ ব্যবসায় প্রশাসনে পড়া শিক্ষার্থীরাই তুলনামূলকভাবে বেশি চাকরি পাচ্ছেন। নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করা ক্ষেত্রেও ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন।

সরকারি গবেষণা সংস্থাটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৫৪টি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের ২০১৭ সালে অনার্স (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর মুঠোফোনে জরিপটি করা হয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা শ্রমশক্তিতে কতটুকু অবদান রাখছেন, তা জানতে এই জরিপ করা হয়েছে। জরিপে ১ হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৩৩ জন চাকরিজীবীর মতামত নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে জরিপের সমন্বয়ক ও বিআইডিএসের গবেষক মিনহাজ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, জরিপে উঠে এসেছে যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে শিক্ষার গুণগত মান ভালো নয়। তাই সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এর সঙ্গে কলেজগুলোতে বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।

জরিপ বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাঁদের গড় বেতন ৩০ হাজার টাকা। আর যাঁরা বেকার রয়েছেন, তাঁদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিভাগের।

তবে করোনার সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো অনলাইন পাঠদানে বেশ ভালো করেছে। ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, করোনার মধ্যে তাঁরা অনলাইনে ক্লাস করেছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে। ৮৪ শতাংশ স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থী চাকরি খুঁজতে ইন্টারনেট বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেন।

জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানেরা স্বীকার করেন, তাঁদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। সেদিকে সরকারের আরও নজর দেওয়া এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেন তাঁরা।

তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো, আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অধিভুক্ত কলেজ আছে ২ হাজার ১৫৪টি। এগুলোর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। সম্মান পড়ানো হয় এ রকম সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৫৭।

দুই বছর আগে বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি জরিপ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যাঁরা তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। এবার বিআইডিএসের জরিপে উঠে এল, বেকারত্বের হার আরও বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে গলদ রয়েছে। শিক্ষার মান, পরিবেশ ও ভালো মানের শিক্ষক—এসবের ঘাটতি আছে। তাই এর অধীনে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মৌলিক দক্ষতাও কম। চাকরির বাজারে তাঁদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও ভালো নয়। তবে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী যে সেখানে পড়াশোনা করে না, তা-ও নয়। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুবই কম।

জরিপমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার ১২ মাসের মধ্যে বিশেষ করে ব্যবসায় প্রশাসন, গণিত, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বেশি চাকরি পান।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মসিউর রহমান বলেন, ‘আমি বলব না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান প্রত্যাশিত। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হারে বিনিয়োগ হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভাবে হয় না। আমরা পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনছি। ভালো লেখকের বই আনার চেষ্টা করছি। করোনার মধ্যেও অনলাইনে ক্লাস চালু রেখেছি। ’

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

Leave a Comment