সমাজবিজ্ঞান

অধিকার কী | অধিকার কাকে বলে | অধিকার কয় প্রকার | অধিকারের প্রকৃতি

1 min read

সাধারণ অর্থে অধিকার বলতে বুঝি মানুষের ইচ্ছামতো কাজ করার ক্ষমতা। কিন্তু অধিকারের এ অর্থ সন্তোষজনক নয়, কেননা অধিকার ও ক্ষমতা এক জিনিস নয়। ক্ষমতা হল পাশবিক বল।

এটি সমাজে কল্যাণকর না হলে অধিকার পদরাচ্য হতে পারে না । সুতরাং, অধিকার হতে হলে একে সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হতে হবে। অধিকার ভোগা করতে হলে যেসব কার্যাবলি সম্পন্ন করতে হয়, তাদের সমষ্টিই কর্তব্য।

যে কোন, রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের কিছু অধিকার রয়েছে। নৈতিক দায়িত্ব হতেই মানুষের মনে অধিকার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র হল আমাদের সমাজের বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিটি সুনাগরিকই রাষ্ট্রের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করে অনেক অধিকার ভোগ করে থাকে। নিম্নে অধিকার সম্বন্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতবাদ প্রকাশ করা হল ঃ

(1) অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “Rights are these conditions of social life without which no man can seek in general to be himself at his best.”

(1) দার্শনিক গ্রীন : “The outer conditions essential for man’s inner development. “

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে অধিকারের সংজ্ঞায় বলা যায়, যেসব সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ব্যতীত মানুষ তার পূর্ণ উন্নতি বিধানে সচেষ্ট হতে পারে না, তাদেরকে অধিকার বলে ।

অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বোসাংকে বলেছেন, “অধিকার হল সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।” বাকারের মতে, অধিকার হল যথাসম্ভব সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সর্বাধিক পরিমাণ সেইসব বাহ্যিক সুযোগসুবিধা, যেগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়। সুতরাং, কোনো সুযোগসুবিধা বা দাবিকে তখনই অধিকার বলা যাবে, যদি তা দুটি শর্ত পূরণ করে।

  •  ১. এইসব সুযোগসুবিধা বা দাবি প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে এবং
  •  ২. এটি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কিও এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, অধিকার হল সমাজজীবনের সেইসব অবস্থা, যেগুলি ছাড়া ব্যক্তির প্রকৃষ্টতম বিকাশ সম্ভব হয় না। সমাজসচেতনতা থেকেই অধিকারবোধের উৎপত্তি বলে গিলক্রিস্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

 

অধিকারের প্রকৃতি

অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা যায় –

1. শুধুমাত্র সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে ব্যক্তি অধিকার ভোগ করতে পারে । মানব সমাজের বাইরে অধিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই ।

2. অধিকারের একটি আইনগত দিক আছে । রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে ।

3.সমাজের সমস্ত মানুষের অধিকার ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার অপরিহার্য ।

4. সমাজ কল্যাণের সঙ্গে অধিকারের ধারণা জড়িত থাকে । বস্তুত , সামাজিক স্বার্থের বিরোধী হওয়া উচিত নয় ।

5. সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে অধিকার পরিবর্তিত হয় ।

6. অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য সম্পাদনের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । কর্তব্য পালন ছাড়া অধিকার ভোগ করা যায় না ।

প্রধানত নিম্নলিখিত দুটি দিক থেকে অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে

প্রথমত, অধিকার একটি সামাজিক ধারণা: অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। কারণ, সমাজজীবনের বাইরে অধিকারের কথা কল্পনাই করা যায় না। গ্রিনের মতে, “পরস্পরের প্রয়োজন সম্পর্কে নৈতিক চেতনাসম্পন্ন সমাজ ছাড়া অধিকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।” সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের মুখসুবিধার সঙ্গে সঙ্গে অপরের সুখসুবিধার কথাও ভাবতে হয়। এইভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি যখন পারস্পরিক সুযোগসুবিধা সম্পর্কে সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করে, তখনই সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অধিকার একটি আইনগত ধারণা: অধিকার হল একটি আইনগত ধারণা। কারণ, অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হওয়ার ফলে সমাজের মধ্যে সকলের আত্মবিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। এদিক থেকে অধিকারকে আইনগত ধারণা বলাই সংগত। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্র নাগরিককে কী পরিমাণ অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, তার ওপর নির্ভর করবে সে কতখানি আনুগত্য তাদের কাছে দাবি করতে পারবে। সুতরাং রাষ্ট্র অধিকার সৃষ্টি করতে পারে না। তাকে স্বীকার ও সংরক্ষণ করে মাত্র। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে। অধিকারের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না—এই যুক্তি মেনে নিতে তিনি রাজি নন। তাঁর মতে, জনগণের এমন কতকগুলি ন্যায়সংগত দাবি থাকে, যেগুলি রাষ্ট্র স্বীকার করে না। কিন্তু সেইসব অধিকারকে মূল্যহীন বা ভিত্তিহীন বলে কোনোমতেই বলা যায় না। তিনি মনে করেন যে, কতকগুলি স্বীকৃত এবং কতকগুলি অস্বীকৃত অথচ স্বীকারযোগ্য অধিকারসমষ্টির মাঝে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে। স্বীকারযোগ্য অধিকারগুলিকে রাষ্ট্র যতখানি স্বীকৃতি দিতে পারবে, ততখানি সে তার অস্তিত্বের সার্থকতা প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে স্বার্থের সংঘর্ষ অনিবার্যভাবে অধিকারের প্রশ্নে বিরোধ সৃষ্টি করে। একদিকে যেমন ধনিকশ্রেণি মুনাফা লাভ করার অবাধ অধিকার দাবি করে, অন্যদিকে তেমনি শ্রমিকশ্রেণি দাবি করে উপযুক্ত মজুরি। এরুপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শ্রেণি-নিরপেক্ষভাবে প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করতে পারে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়। তাই ধনতান্ত্রিক সমাজে নীতি হিসেবে স্বীকৃত হলেও মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

 

অধিকার কয় প্রকার

প্রকৃতিগতভাবে অধিকারকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । এর মধ্যে একটি হল নৈতিক অধিকার এবং অন্যটি হল আইনগত অধিকার ।

নৈতিক অধিকার :

যেসব অধিকার সামাজিক ন্যায় নীতিবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাদের নৈতিক অধিকার বলা হয় । প্রসঙ্গত বলা যায় , নৈতিক অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনো শাস্তি দিতে পারে না । নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত নয় ।

আইনগত অধিকার :

যেসব অধিকার আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত হয় তাদের আইনগত অধিকার বলে । আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে । যেমন ভোটদান করার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার । এই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারে ।

আইনগত অধিকারকে প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয় । সেগুলি হল—

( ক ) পৌর অধিকার ,

( খ ) রাজনৈতিক অধিকার ,

( গ ) অর্থনৈতিক অধিকার এবং

( ঘ ) সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার ।

 

ক. পৌর অধিকারসমূহ (Civil Rights)

যেসব সুযোগসুবিধা ছাড়া মানুষ সভ্য ও সামাজিক জীবনযাপন করতে পারে না এবং যে-সুযোগের অভাবে ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধন ব্যাহত হয়, সেইসব সুযোগসুবিধাকে পৌর অধিকার বলা হয়। বর্তমানে নিম্নলিখিত পৌর অধিকারগুলিকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করা হয় ।

১. জীবনের অধিকারঃ

জীবনের অধিকার অর্থাৎ বেঁচে থাকার অধিকার হল মানুষের মৌলিক অধিকার। জীবনের নিরাপত্তা না থাকলে অন্যান্য অধিকার ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়। জীবনের অধিকার বলতে
আত্মরক্ষার অধিকার এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অধিকারকেও বোঝায়।

২.  চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারঃ

স্বাধীন চিন্তার অধিকার মানুষের মানসিক ও নৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি। চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার বলতে বাকস্বাধীনতা ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাকে বোঝায়। এরূপ স্বাধীনতা হল গণতান্ত্রিক সরকারের মূলভিত্তি। এই অধিকার সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়। অবশ্য সদাচার, শালীনতা, রাষ্ট্রীয় সংহতি ও নিরাপত্তা প্রভৃতি রক্ষার জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারের ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে। তবে বাধানিষেধগুলি যুক্তিসংগত কি না, তা বিচার করার অধিকার নিরপেক্ষ আদালতের থাকা উচিত।

৩. ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারঃ

স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং সংঘ বা সমিতি গঠন করার অধিকার মানুষের ব্যক্তিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়। কোনো ব্যক্তিকে বিনাবিচারে আটক করা বা ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার করা প্রভৃতি এই অধিকারের বিরোধী। তবে জাতীয় বিপদের দিনে অর্থাৎ।জরুরি অবস্থার সময় জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে এই অধিকারটিকে ক্ষুণ্ন করা যেতে পারে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, কোনো অবস্থাতেই এই অধিকারটিকে সংকুচিত করা উচিত নয়।

৪. কার্যের অধিকারঃ

জীবনের সঙ্গে জীবিকার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জীবনধারণের জন্য প্রতিটি কর্মক্ষম ব্যক্তির কার্যে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেই রাষ্ট্রের কর্তব্য শেষ হয় না; দক্ষতা অনুযায়ী উপযুক্ত মজুরি লাভের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

৫. সম্পত্তির অধিকারঃ

সম্পত্তির অধিকার বলতে বোঝায় ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জন ও রক্ষা এবং সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় ও ভোগ করার অধিকার। নিজ সম্পত্তি দান ও হস্তান্তর করার অধিকারও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সম্পত্তির অধিকার থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদের যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।

৬. পরিবার গঠনের অধিকারঃ

পরিবার গঠনের অধিকার বলতে বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন করার সুযোগসুবিধাকে বোঝায়। পিতামাতা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততি এবং পত্নীকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার গঠন মানুষের পৌর অধিকার।

৭. ধর্মের অধিকারঃ

স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করার অধিকার মানুষের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমার ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচারের অধিকার আছে বলে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার করার কোনো অধিকার আমার নেই। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি যাতে অন্য ধর্মে হস্তক্ষেপ না ক’রে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করতে পারে, সেদিকে রাষ্ট্র সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে।

৮. শিক্ষার অধিকারঃ
সভ্য সমাজ গঠনের কাজে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ছাড়া মানুষ কখনই আত্মসচেতন ও সমাজসচেতন হয়ে উঠতে পারে না। সর্বোপরি, শিক্ষাই মানুষের বৃত্তি, সামাজিক।মর্যাদা, চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রভৃতি বিকাশে সহায়তা করে। তাই শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের।কর্তব্য।
৯. চুক্তির অধিকারঃ

যে-কোনো ব্যক্তি ন্যায়সংগতভাবে একে অপরের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করার অধিকারী। এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি সাধিত হতে পারে। কিন্তু অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকার যে-কোনো চুক্তিকে রাষ্ট্র বেআইনি বলে ঘোষণা করতে সক্ষম।

১০. সাম্যের অধিকারঃ

আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং আইন কর্তৃক সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে সাম্যের অধিকার বলে। জাতিধর্মবর্ণ, স্ত্রীপুরুষ ও ধনীনির্ধন-নির্বিশেষে সকলকেই আইন সমদৃষ্টিতেদেখবে।
উপরিউক্ত পৌর অধিকারগুলির কোনোটিই অবাধ ও নিরুঙ্কুশ হতে পারে না। প্রতিটি অধিকার ভোগের সঙ্গে কর্তব্যপালন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কর্তব্য পালন না করলে কোনো ব্যক্তি নিজ অধিকার দাবি করতে পারে না।

খ. সামাজিক অধিকারসমূহ (Social Rights)

নাগরিকদের সামাজিক জীবন সুন্দর ও সার্থক ক’রে গড়ে তোলার জন্য কতকগুলি সামাজিক সুযোগসুবিধা একান্ত অপরিহার্য। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হলে সেগুলিকে সামাজিক অধিকার বলা হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেসব সামাজিক অধিকার স্বীকৃতিলাভ করেছে, সেগুলির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য-

 ১. শিক্ষার অধিকারঃ

সভ্যসমাজ গঠনের কাজে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ছাড়া মানুষ কখনোই আত্মসচেতন হয়ে উঠতে পারে না। সর্বোপরি, শিক্ষা মানুষের বৃত্তি, সামাজিক মর্যাদা, চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রভৃতি বিকাশে সহায়তা করে। তাই শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের কর্তব্য।

২. ধর্মের অধিকারঃ
স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করার অধিকারকে ধর্মের অধিকার বলে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি ব্যক্তি যাতে অপরের এই অধিকারে হস্তক্ষেপ না ক’রে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করতে পারে, সেদিকে রাষ্ট্র সতর্ক দৃষ্টি রাখে।
৩. সুস্থ পরিবেশে বসবাসের অধিকারঃ

সুস্থ সামাজিক পরিবেশে বসবাস করা প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার। কিন্তু অনেক সময় কিছুসংখ্যক ব্যক্তি অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকার ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই সমাজজীবনের সুস্থ পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

৪.স্বাস্থ্যের অধিকারঃ

প্রতিটি পুরুষ ও নারী যাতে সুস্থ ও সবল দেহের অধিকারী হতে পারে, সেজন্য যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। রুগ্ণ ও ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিজ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে পারে না। তাই এই অধিকার স্বীকার করে নেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য।

৫. সাম্যের অধিকারঃ

সামাজিক দিক থেকে বিচার ক’রে বলা যায় যে, স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে সমাজের সকলে সমান কার্যের জন্য সমান বেতন পাওয়ার অধিকারী। জাতি, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র মানুষের মধ্যে কোনোরকম ভেদ-বিচার করবে না।

গ. রাজনৈতিক অধিকারসমূহ (Political Rights)

রাজনৈতিক অধিকার বলতে রাষ্ট্রীয় কার্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকে বোঝায়। জনগণই হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সার্বভৌম। তাই জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন অসম্ভব। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকারগুলি হল:

১. ভোটদানের অধিকারঃ
রাজনৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে ভোটদানের অধিকার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারই প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটদানের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। তবে নাবালক, বিকৃতমস্তিষ্ক, দেউলিয়া, বিদেশি প্রভৃতি ব্যক্তিকে ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
২. নির্বাচিত হওয়ার অধিকারঃ

যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বীকৃতিলাভ করেছে। যোগ্য নাগরিক আইনসভা কিংবা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির সভ্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন।

৩. সরকারি চাকুরির অধিকারঃ

উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিক সরকারি কার্যে নিযুক্ত হওয়ার অধিকারী। সরকারি চাকুরি প্রদানের ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র কোনো যোগ্য‌।নাগরিককে সরকারি কার্যে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।

৪. আবেদন করার অধিকারঃ

নিজেদের।অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাগরিকরা তার যথোচিত প্রতিবিধান দাবি করতে পারে। এই অধিকার নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার।

৫. সমালোচনার অধিকারঃ

সরকারের কোনো কাজের ফলে নাগরিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে বা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নাগরিকরা সেই কার্যের সমালোচনা করতে পারে। সরকারের সমালোচনার অর্থ রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়।

৬. বিপ্লবের অধিকারঃ

ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির দ্বারা শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়। এরুপ রাষ্ট্রে বা সমাজব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কোনোরূপ কল্যাণ সাধিত হয় না। তাই মার্কসবাদীরা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজবিপ্লবে অংশগ্রহণ করার অধিকারকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অধিকার বলে মনে করেন।

ঘ. অর্থনৈতিক অধিকারসমূহ (Economic Rights)

অর্থনৈতিক অধিকার হল সেইসব অধিকার, যেগুলি অভাব-অনটন ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষের জীবনকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও নিরাপদ করে তোলে। অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায়, দৈনন্দিন অন্নসংস্থানের ব্যাপারে যুক্তিসংগত অর্থ উপার্জনের সুযোগ ও নিরাপত্তাকেই অর্থনৈতিক অধিকার বলে। যে সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই, সেখানে শ্রমিকরা ধনশালী মালিকদের আজ্ঞাবহ দাসমাত্র। তাই বার্কার মন্তব্য করেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীন শ্রমিক কখনোই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন হতে পারে না। সুতরাং সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের যথার্থ রূপদানের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি একান্ত অপরিহার্য। অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল

১. কর্মের অধিকারঃ

কর্মের অধিকার অর্থনৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কর্মের অধিকার বলতে বোঝায় প্রতিটি ব্যক্তি তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে কর্মে নিযুক্ত হতে পারবে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল প্রত্যেকের সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে কর্মে নিযুক্ত করা। কর্মের অধিকার না থাকলে ব্যক্তি কখনোই সম্যকভাবে তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাই বিশ্বের প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কর্মের অধিকার স্বীকৃতিলাভ করেছে।

২. উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অধিকারঃ
কেবল কর্মের অধিকার থাকলেই ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ সুগম।হয় না। উপযুক্ত কার্যের জন্য উপযুক্ত বেতন দেওয়া না হলে কর্মের অধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই বেতন প্রদানের সময় কার্যের গুণ ও পরিমাণের দিকে লক্ষ রাখা বিশেষ প্রয়োজন। তবে প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান বজায় রাখার জন্য যেটুকু বেতন প্রয়োজন, সেটুকু তাকে প্রদান করতে হবে।
৩. অবকাশের অধিকারঃ

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল বলেছেন, সুন্দর জীবনের জন্য অবকাশ অপরিহার্য। সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অবকাশের অধিকার একান্ত প্রয়োজন। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন অবকাশের। তা ছাড়া, অবকাশ না থাকলে মানুষ যন্ত্রতুল্য হয়ে পড়ে। দিবারাত্র কর্মরত থাকলে মানুষ চিত্ত-বিনোদনের সময় পায় না। তাই বৈচিত্রাহীন জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার অন্তরাত্মা অনেক সময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে সমাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

৪. প্রতিপালিত হওয়ার অধিকারঃ

কর্মক্ষম অবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী রাষ্ট্র তথা সমাজের জন্য কাজ করে। কিন্তু বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্র না করে, তবে অন্যায় করা হবে। তাই সমাজতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রসমূহে বার্ধক্য ভাতা, বিমা পরিকল্পনা, প্রভিডেন্ট ফান্ড পরিকল্পনা প্রভৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। অনুরূপভাবে, বিকলাঙ্গ, মারাত্মক ব্যাধিগ্রস্ত প্রভৃতি ব্যক্তির প্রতিপালনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত।

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “অধিকার কী | অধিকার কাকে বলে” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

5/5 - (38 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x