International

স্নায়ু যুদ্ধ কি? | স্নায়ু যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

1 min read
১৯৫০ সালের জুনে সোভিয়েত-সমর্থিত উত্তর কোরিয়ার জনগণের সেনাবাহিনী দক্ষিণে পশ্চিমাপন্থী দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করলে শীতল যুদ্ধের প্রথম সামরিক পদক্ষেপ শুরু হয়। ১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকেই ধীরে ধীরে এর ব্যপ্তি বাড়তে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধ কী? একদম সহজ ভাষায় শীতল যুদ্ধ হচ্ছে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব কিন্তু সরাসরি কোন যুদ্ধ নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মিত্র শক্তি। যদিও যুদ্ধের আগে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। বরাবরের মতই আমেরিকানরা দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত কমিউনিজম সম্পর্কে সতর্ক ছিল। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর থেকেই রাশিয়া দিন দিন কমিউনিজম বিস্তার করে আসছিল। তাদের মতাদর্শ অনেক ইউরোপীয় দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে। পূর্ব ইউরোপে এই সোভিয়েত সম্প্রসারণবাদ অনেক আমেরিকানকে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।

স্নায়ু যুদ্ধ কি?

 ‘কোল্ড ওয়ার‘ শব্দটি ইংরেজ লেখক জর্জ  অরওয়েলের “You and the Atomic Bomb” নামে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত  একটি প্রবন্ধে প্রথম ব্যবহার করেন।

স্নায়ু যুদ্ধের কারণ

১৯৪৫ সালে মে মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আত্মসমর্পণের করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকালীন মিত্রশক্তি জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিজমবাদ বিস্তার করে।। আমেরিকান এবং ব্রিটিশরা পূর্ব ইউরোপের স্থায়ী সোভিয়েত আধিপত্য এবং পশ্চিম ইউরোপের গণতন্ত্রে সোভিয়েত-প্রভাবিত কমিউনিস্ট দলগুলির ক্ষমতায় আসায় এটিকে তাদের জন্য হুমকির আশঙ্কা মনে করেছিল।
অন্যদিকে, সোভিয়েতরা জার্মান এবং অন্যন্য ইউরোপীয় দেশ থেকে যে কোনও নতুন উদ্ভূত হুমকির বিরুদ্ধে রক্ষার জন্য পূর্ব ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিল। এবং মূলত আদর্শিক কারণে তারা বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
পরাশক্তিদের মধ্যে লড়াই
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল নাগাত শীতল যুদ্ধ চরম পর্যায়ে পৌছে যায়। এই সময়কালে সোভিয়েতরা ব্যর্থ হয়ে পশ্চিম বার্লিনের অধিষ্ঠিত জায়গা অবরুদ্ধ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো সামরিক চুক্তি উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো) গঠন করে। মূলত এই সামরিক জোট ইউরোপে সোভিয়েতের উপস্থিতি রোধ করার জন্য। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েতরা তাদের প্রথম পারমাণবিক টর্পেডো বিস্ফোরিত করে। এর মাধ্যমে আমেরিকার পারমাণবিক বোমার উপর একচেটিয়া আধিপাত্যের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্টরা চীন ভূখণ্ডে ক্ষমতায় আসে। উত্তর কোরিয়ার সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার ১৯৫০ সালে মার্কিন-সমর্থিত দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে। এই আক্রমণ তখনকার দুই পরাশক্তি দেশ রাশিয়া এবং আমেরিকানদের মধ্যে চরম বিভেদ তৈরি করে। কমিউনিজবাদ রুখতে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন দেয় এবং সৈন্য প্রেরণ করে।  ১৯৫৩ সালে এই অমিমাংশিত কোরিয়া যুদ্ধ বন্ধ হয়। তবে শীতল যুদ্ধ আরো বাড়তে থাকে।
১৯৪৯ সালে শুরু হয় মারাত্মক “অস্ত্রের লড়াই”। সোভিয়েতরা তাদের নিজস্ব একটি অ্যাটম বোমা পরীক্ষা করলে এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে, রাষ্ট্রপতি ট্রুমান ঘোষণা করেছিলেন যে, আমেরিকা আরও ধ্বংসাত্মক পরমাণু অস্ত্র হাইড্রোজেন বোমা বা “সুপারবম্ব তৈরি করবে “।
তারা মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে সর্ব প্রথম হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করে দেখিয়েছে যে, পারমাণবিক যুগ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই বোমা ২৫ বর্গমাইল অগ্নিবলই তৈরি করেছে যা একটি দ্বীপকে মূহুর্তে বাষ্পীভূত করে দেয় এবং সমুদ্রের তলদেশে একটি বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে।। ঠান্ডা যুদ্ধের এসকল লড়াইয়ে আমেরিকান এবং সোভিয়েত বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ছড়িয়ে দেয়।
১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সদস্য দেশ উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থায় (ন্যাটো) পশ্চিম জার্মানিকে এর সদস্য করে। এছাড়া পূর্ব জার্মানিকে পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেয়। বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্শাল ইভান এস কোনেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আলবেনিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া এবং বুলগেরিয়ার মধ্যে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা ওয়ার্সা চুক্তির করে।

স্নায়ু যুদ্ধের যুদ্ধের ফলাফল

রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু করেন। বিশ্বকে প্রতিকূল, “দ্বি-মেরু” স্থান হিসাবে দেখার পরিবর্তে কূটনীতি সমঝোতা সম্পর্কের ব্যবহার করা হবে বলে তিনি পরামর্শ দেন। সে লক্ষ্যে তিনি জাতিসংঘকে কমিউনিস্ট চীনা সরকারকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করেন। ১৯৭২ সালে রিচার্ড নিকসন বেইজিং ভ্রমণ শেষে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের যাত্রা শুরু করে।। একই সাথে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথেও “শিথিলকরণ” নীতি গ্রহণ করেন।
১৯৭২ সালে তিনি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী লিওনিড ব্রেজনেভ কৌশলগত অস্ত্র সীমাবদ্ধতা চুক্তিতে (SALT I) স্বাক্ষর করেন, যা উভয় পক্ষের দ্বারা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি নিষিদ্ধ এবং পরমাণু যুদ্ধের হুমকি হ্রাস করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
নিক্সনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগনের অধীনে শীতল যুদ্ধ আবারও উত্তপ্ত হয়। তাঁর প্রজন্মের অনেক নেতার মতোই রেগান বিশ্বাস করেছিলেন যে, কমিউনিজমের বিস্তার সর্বত্রই স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফলস্বরূপ, তিনি বিশ্বজুড়ে বিরোধী সরকার এবং বিদ্রোহীদের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার কাজ করেন। এটি রিগন মতবাদ হিসাবে পরিচিত।
এমনকি রেগান মধ্য আমেরিকাতেও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।। মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৮৫ সালে সোভিয়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তিনি দুটি নীতি চালু করেছিলেন। এক, glasnost বা রাজনৈতিক উন্মুক্ততা বা উদারতা এবং ” perestroika, ”বা অর্থনৈতিক সংস্কার। তখন থেকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে।
১৯৮৯ সালে নভেম্বরে, কয়েক দশক ধরে চলমান শীতল যুদ্ধের সর্বাধিক দৃশ্যমান প্রতীক বার্লিন প্রাচীর অবশেষে ধ্বংস হয়ে যায়। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই সাথে শীতল যুদ্ধও শেষ হয়।
5/5 - (11 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x