ইউনেস্কো কি? গঠন, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী

ইউনেস্কো কি?

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (The United Nations Educational, Scientific, and Cultural Organization) বা ইউনেস্কো জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা যার লক্ষ্য শিক্ষা, কলা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রচার।
বিশ্বে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসার এবং উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, লন্ডন সম্মেলনে ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৬ সালে এই সংস্থা জাতিসংঘের সহায়ক সংস্থা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফ্রান্সের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারে সংস্থাটির সদর দপ্তর
অবস্থিত।
ইউনেস্কো ১৬ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটির ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র এবং ১২টি সহযোগী সদস্য রয়েছে। এছাড়া সংস্থাটির ৫৩টি আঞ্চলিক ফিল্ড অফিস এবং ১৯৯টি জাতীয় কমিশন রয়েছে। ২৭ অক্টোবর ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশ ইউনেস্কোর সদস্যপদ লাভ করে।

ইউনেস্কোর উদ্দেশ্য

  • সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষা অর্জন এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা।
  • টেকসই উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানের জ্ঞান।
  • উদীয়মান সামাজিক এবং নৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা।
  • বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ সমতা রক্ষা করা।
  • বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষা করা।
  • সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, আন্তঃসাংস্কৃতিক কথোপকথন এবং শান্তির সংস্কৃতি বৃদ্ধি করা।
  • তথ্য ও যোগাযোগের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক জ্ঞান সমাজ গড়ে তোলা।
  • বিশ্ব মানবাধিকার, পারস্পরিক সম্মান এবং দারিদ্র্য বিমোচন।
  • মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং জনগণের মধ্যে সংলাপের শর্ত তৈরি করতে কাজ করা।
  • টেকসই উন্নয়ন এবং শিক্ষা, বিজ্ঞানে অবদান রাখা।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রচার।
  • সকল দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন।
  • প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা।
  • টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি জাতীয় কৌশল বাস্তবায়নে সাহায্য করা।
  • গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের পরিবেশগত ক্ষতির প্রবণতা হ্রাস করা।

ইউনেস্কোর গঠন

ইউনেস্কোর সংবিধান অনুসারে তিনটি পরিচালনা সংস্থা রয়েছে: যেমন সাধারণ সম্মেলন, নির্বাহী বোর্ড এবং সচিবালয়। এই সংস্থাগুলি ইউনেস্কোর কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
১. সাধারণ সম্মেলন (General Conference)
UNESCO সাধারণ সম্মেলন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রতি দুই বছরে একবার প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়। এটি ইউনেস্কোর সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা। সাধারণ সম্মেলন দ্বিবার্ষিক বাজেট অনুমোদন করে।
সাধারণ সম্মেলন ইউনেস্কোর নীতি নির্ধারণ করে এবং এর প্রধান উদ্যোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত, সাধারণ সম্মেলন প্রতি বছর মিলিত হত। তারপর থেকে এটি সাধারণত প্রতি দুই বছরে মিলিত হয়। সাধারণ সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে নেওয়া হয়।
২. কার্যনির্বাহী বোর্ড (Executive Board)
কার্যনির্বাহী বোর্ড প্রশাসনিক ও নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত হয়েছে। এর সদস্যরা সাধারণ সম্মেলনের দ্বারা ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এটি ইউনেস্কোর কর্মসূচি বাস্তবায়নের তদারকি করে। এটি বছরে অন্তত দুবার মিলিত হয়। সাধারণ সম্মেলন আহ্বানের আগে, নির্বাহী বোর্ড পরবর্তী দুই বছরের জন্য বাজেট প্রাক্কলন এবং কাজের কর্মসূচি পর্যালোচনা করে। এটি সাধারণ সম্মেলনে তার সুপারিশ এবং সম্মেলনের জন্য এজেন্ডা প্রস্তুত করে।
কার্যনির্বাহী বোর্ডের ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্রই কমিশনে প্রতিনিধিত্ব করে। তারা আলোচ্যসূচির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে এবং প্রয়োজনে সচিবালয়ের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আরও তথ্য সংগ্রহ করে।
৩. সচিবালয় (Secretariat)
সচিবালয় ইউনেস্কোর সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটির নেতৃত্বে থাকেন একজন মহাপরিচালক, যিনি নির্বাহী বোর্ড কর্তৃক মনোনীত এবং সাধারণ সম্মেলন দ্বারা নির্বাচিত। যুক্তরাজ্যের জুলিয়ান হাক্সলি ছিলেন ইউনেস্কোর প্রথম মহাপরিচালক।
ইউনেস্কোর বর্তমান মহাপরিচালক হলেন ফরাসি নাগরিক অড্রে আজৌলে। তিনি ১০ নভেম্বর ২০১৭-এ প্যারিসে ৩৯তম সাধারণ সম্মেলনের দ্বারা নির্বাচিত হন এবং তিনি ইউনেস্কোর ১১ তম মহাপরিচালক।
ইউনেস্কোর সচিবালয় প্যারিসে অবস্থিত। এর প্রধান কাজ হল সংস্থাটির সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত করা, প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ করা, এবং তহবিল পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয় করা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা।

ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য

ইউনেস্কো ‘‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’’ হল সাংস্কৃতিক বা প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ, যা ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশনে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ (স্থাপত্য, স্মারক ভাস্কর্য) বা শিলালিপি), বিল্ডিং, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট। এছাড়াও রয়েছে ভূতাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক স্থান যা বিজ্ঞান, সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত, ১৬৭টি দেশে মোট ১,১৫৪টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৯৭টি সাংস্কৃতিক, ২১৮টি প্রাকৃতিক এবং ৩৯টি মিশ্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সবচেয়ে বেশি ঐতিহ্যবাহী স্থান আছে এমন দেশগুলো হল ইতালি (৫৮), চীন (৫৬), জার্মানি (৫১), ফ্রান্স (৪৯), স্পেন (৪৯), ভারত (৪০), মেক্সিকো (৩৫), যুক্তরাজ্য (৩৩) এবং রাশিয়া (৩০)।
৩ আগস্ট ১৯৮৩ সালে, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশনটি গ্রহণ করে। ২০২২ সালের হিসাবে, বাংলাদেশে ৩টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রথম দুটি সাংস্কৃতিক স্থান হলো বাগেরহাটের মসজিদ শহর এবং পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। সুন্দরবন, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের তৃতীয় বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল এবং এটি একটি প্রাকৃতিক সাইট।

Similar Posts