১৭৮০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে ব্রিটেন ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যা ১ম ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত। ১ম ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম হয়। চুক্তির তিন বছর পর, ৩ সেপ্টেম্বর ১৭৮৩ সালে, আমেরিকা পূর্ন স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু ২য় ভার্সাই চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে।
২য় ভার্সাই চুক্তি
১৯১৯ সালের ২৮ শে জুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদে মিত্র শক্তি এবং জার্মানি কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি শান্তি দলিল, যা ২য় ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তিটি ১০ জানুয়ারী, ১৯২০ সালে কার্যকর হয়।
২য় ভার্সাই চুক্তিতে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, অটোমান সাম্রাজ্য, পর্তুগাল, সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং যুক্তরাজ্য অংশগ্রহণ করে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে, উড্রো উইলসন একটি সাধারণ যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা করেছিলেন। যাইহোক, মিত্ররা স্থল, সমুদ্র এবং বিমান দ্বারা জার্মান আগ্রাসনে বেসামরিক জনগোষ্ঠী এবং তাদের সম্পত্তির ক্ষতির জন্য জার্মানির নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
১৯১৯ সালের প্যারিস সম্মেলনে “বিগ ফোর” নামে খ্যাত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্লেমেন্সো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী ভিটোরিও অরল্যান্ডোর প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, প্রথম তিনজন ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরাজিত দেশের কেউই এই চুক্তি গঠনে কোন মতামত ব্যক্ত করতে পারে নি। জার্মান প্রতিনিধিরা শর্তগুলির তীব্রতায় হতবাক হয়েছিলেন।
ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলী
যুদ্ধের অপরাধ এবং ক্ষতিপূরণের শর্তাবলী গ্রহণ করা জার্মানদের জন্য খুবই ঘৃণ্য ছিল। চুক্তি দ্বারা জার্মানির জনসংখ্যা এবং অঞ্চল প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। জার্মানির পশ্চিমে আলসেস এবং লরেন অঞ্চল ফ্রান্সের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া সারল্যান্ডকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত লীগ অব নেশনস এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। উত্তরে তিনটি ছোট এলাকা বেলজিয়ামকে দেওয়া হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগর এবং আফ্রিকার জার্মান উপনিবেশগুলি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অন্যান্য মিত্র দেশগুলো দ্বারা দখল করা হয়।
জার্মান ক্ষতিপূরণ এবং সামরিক সীমাবদ্ধতা।
যুদ্ধাপরাধের চুক্তির ধারা অনুযায়ী জার্মানিকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং মিত্র দেশগুলিকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিতে জার্মানিকে দায়ী করে। চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা জার্মানদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। ১৯২১ সালে, একটি কমিশন বেসামরিক জনগণের ক্ষতির মূল্যায়ন করেছিল, যার পরিমাণ ছিল ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চুক্তি অনুসারে জার্মানি ক্ষতিপূরণ না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতিও দেওয়া হয়।
দ্য বিগ ফোর নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে, জার্মানি যেন আর কখনও ইউরোপের বাকি দেশগুলোর জন্য সামরিক হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। তাই চুক্তির এই লক্ষ্যসমূহ নিশ্চিত করার জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়। শর্তসমূহ যেমন,
- জার্মান সেনাবাহিনীকে মাত্র ১ লক্ষ পুরুষের সৈনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়।
- সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাংক, সাবমেরিন, বিমান এবং বিষাক্ত গ্যাস তৈরীও নিষিদ্ধ।
- শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক কারখানায় অস্ত্র বা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে পারবে।
- সমস্ত জার্মানি রাইনের পশ্চিমে এবং এর ৩০ মাইল পূর্বে পর্যন্ত একটি অসামরিক অঞ্চল হবে।
ভার্সাই চুক্তির ফলাফল
লীগ অফ নেশনস গঠন: ২য় ভার্সাই চুক্তিতে লিগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জ গঠনের একটি চুক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে সদস্য দেশগুলো একে অপরের স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিশ্চিত করবে। উইলসন দৃঢ় প্রত্যয় ছিলেন যে, একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের অস্তিত্ব না থাকলে, বিশ্বে কোন স্থায়ী শান্তি সম্ভব হবে না। তিনি লিগ অব নেশনস কমিশনের সভাপতিত্ব করেন এবং এর রুপরেখা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন।
২৮ এপ্রিল, ১৯১৯ সালে, প্যারিস সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে কয়েকটি প্রদক্ষেপ গৃহীত হয়। যেমন,
- যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যে কোন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হবে। বিতর্কিত অঞ্চল তত্ত্বাবধান করা এবং অস্ত্র কমানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
- আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের স্থায়ী আদালত এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করে।
কিন্তু ১৯২০ সালের মার্চ মাসে, মার্কিন সিনেট কর্তৃক জাতিপুঞ্জে আমেরিকান সম্পৃক্ততা অনুমোদন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
জার্মানদের অপমানবোধ: ১৯১৯ সালের ৭ই মে, ভার্সাই চুক্তির চূড়ান্ত রুপটি একটি জার্মান প্রতিনিধি দলের কাছে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিনিধিদের তীব্র আপত্তি থাকার পরও ২জুন তারিখে এটি স্বাক্ষরিত হয়। ২য় ভার্সাই চুক্তি অনুমোদিত হওয়ার কয়েক বছর পরে, এর কিছু সংশোধন ও পরিবর্তন আনা হয়। যার বেশিরভাগই ছিল জার্মানির পক্ষে। অ্যাডলফ হিটলারের উত্থানের আগে জার্মানিকে অসংখ্য ছাড় দেওয়া হয়েছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, ২য় ভার্সাই চুক্তির কঠোর শর্তাবলী এবং পরবর্তীকালে এর বিধানের শিথিল প্রয়োগ ১৯৩০ এর দশকে জার্মান সামরিক উত্থানের পথ সুগম করেছিল। বিপুল পরিমাণ জার্মান ক্ষতিপূরণ এবং যুদ্ধের অপরাধমূলক ধারা জার্মানিতে গভীর অসন্তোষ জাগিয়ে তোলে।