ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে লখনৌ চুক্তি প্রথম হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে বিবেচিত। ১৯১৬ সালের এই চুক্তির মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হয়। নিম্মে লখনৌ চুক্তি কি, এর পটভূমি, চুক্তির শর্ত এবং ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হল।
লখনৌ চুক্তি
লখনৌ চুক্তি, মারাঠা নেতা গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ দ্বারা সম্পাদিত একটি চুক্তি।চুক্তিটি ১৯১৬ সালের ২৯শে ডিসেম্বর কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে এবং ৩১শে ডিসেম্বর, মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। এটি ভারত সরকারের কাঠামো এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে, লখনৌতে দুই দলের যৌথ অধিবেশনে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বরুপ লখনৌ চুক্তি হয়।
লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের দুটি কারণ ছিল—
(১) ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গে সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়া এবং
(২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা।
(১) ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গে সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়া এবং
(২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা।
লখনৌ চুক্তির শর্ত
- মুসলিম লিগ কংগ্রেসের স্বায়ত্তশাসনের নীতি মেনে নেবে।
- কংগ্রেস মুসলিম লিগের পৃথক নির্বাচন নীতির স্বীকৃতি জানাবে।
- প্রতিটি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক তৃতীয়াংশ সদস্য মুসলিম প্রতিনিধি থেকে হবে।
- মুসলিম লিগ ও কংগ্রেস সদস্যরা যৌথভাবে স্বায়ত্তশাসনের আদায়ের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে।
- উভয় দলই স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট দিন, তারিখ, প্রভৃতি ঘোষণার দাবি জানাবে।
লখনৌ চুক্তির ফলাফল
লখনৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ঐক্য স্থাপনে ব্রিটিশ সরকারের যথেষ্ট শঙ্কার কারণ হয়েছিল। এটি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই চুক্তি প্রমাণ করেছিল যে, ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও জাতীয় প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে মিলিত হতে পারে।
এই চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়। অর্থাৎ এই প্রথম কংগ্রেস মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। চুক্তির ফলে, মুসলমানরা তিনটি বিষয়ের সুবিধা লাভ করে। যেমন –
১. আইন সভার স্বতন্ত্র নির্বাচন।
২. মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে তাদের ওপর গুরুত্বারোপ।
৩. আইন সভায় কোন সম্প্রদায়কে প্রভাবিত বা বিরুদ্ধে যায় এমন কোন বিল বা প্রস্তাব উত্থাপিত হলে এবং সে প্রস্তাব যদি উক্ত সম্প্রদায়ের ৩/৪ অংশ বিরোধিতা করে তাহলে সে বিল বা প্রস্তাব গৃহীত হবে না। এই আইন অবশ্যই হিন্দুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল।
লখনৌ চুক্তির মাধ্যমে স্বায়শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি মুসলমানদের সর্বপ্রথম সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। চুক্তির ফলে কংগ্রেস বিশেষভাবে লাভবান হয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস মুসলিম লীগের সমর্থন লাভ করে । ফলে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে কংগ্রেসের আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়।
ভারতের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের উপর এই চুক্তির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লখনৌ চুক্তির অধিকাংশ নীতিই ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে কিছু রদবদল সহকারে যোগ করা হয়। হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হয় ।