মুজিববাদ হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন বা মূল্যবোধের সমষ্টি। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের চারটি মূল নীতি হল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন, ‘‘১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে মুজিববাদের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।’’
মুজিববাদ হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শন, ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্মিলন যার দর্শনের উপর ভিত্তি করে মুজিব বাঙালি জাতিকে এক সুরে গেঁথে ফেলে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ও স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মুজিববাদ হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার অপূর্ব সম্মিলন।
সর্বপ্রথম, উপনিবেশিক আমলে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। মুজিবের রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে থেকে।
মুজিবাদের চারটি দর্শন রয়েছে যথা- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চারটি দর্শন বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। নিম্মে মুজিবাদের দর্শনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. জাতীয়তাবাদ
ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের সকল অধিবাসীর পরিচয় বাঙালি ও বাংলাদেশী। তিনি ভেদাভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্তম্ভ মনে করতেন।
বাংলা ভাষাকে, ও বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল মুজিববাদের মূল লক্ষ্য।
জাতীয়তা একটি ধারণা মাত্র। কোন জাতি বা গোষ্ঠীর ঐক্য ও সংহতির প্রবল অনুভূতি যা চেতনা তৈরি করে একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে অন্য একটি জনসমষ্টি হতে আলাদা করতে পারে তাই জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের কিছু প্রধান উপাদান যেমন ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খাদ্যভাব, এবং ভৌগলিক সীমারেখা। এগুলোর মাধ্যমে একটি জাতিকে অপর জাতি থেকে আলাদা করা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হবে ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। যে ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে।
২. সমাজতন্ত্র
মানুষের উপর মানুষের শােষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজতাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।
মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ হল সমাজতন্ত্র। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ, গণতান্ত্রিক এবং শোষনহীন সমাজতন্ত্র। কুষ্টিয়ায় এক সভায় তিনি বলেন, ‘‘সম্পত্তি এখন সাড়ে সাতকোটি লোকের। যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এদেশ শোষণহীন সমাজ হবে।’’
সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে মূলত একটি শোষণহীন, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ, সুবিধা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
৩. গণতন্ত্র
সংবিধানে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে সংগ্রাম করে আজ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হবে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। জনেগণের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার প্রয়োগ, এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সকল পর্যায়ে অংশগ্রহনের মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণকে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েই জনগণের মতামতের উপর আমরা বিশ্বাস করি। তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কথাটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘‘শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হল জনগণ।’’
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা
সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্র নির্দিষ্টভাবে কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দিবেনা। সকল ধর্ম সমান ও সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। কোন ব্যক্তি তারঁ ধর্মের জন্য যেন কোনভাবেই বৈষম্যের শিকার না হয় তার জন্য এই ধর্মনিরপেক্ষতা।
মুজিববাদের চতুর্থ দর্শন ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। তার মতে, ‘‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে; আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম, মুসলমানেরা মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে।’’
তিনি আরো বলেন,
‘‘ধর্মনিরপেক্ষতা… ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে, শুধু আমার আপত্তি এইখানে যে পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে যেন একে আর গান্ধা না করা হয় ভবিষ্যতে।’’