পার্বত্য শান্তি চুক্তি কি?
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বা পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলো ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি রাজনৈতিক এবং শান্তি চুক্তি যা বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এর মধ্যে সম্পাদিত হয়। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিক চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণ ও উপজাতিদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে। সেইসাথে শান্তিবাহিনী এবং সরকারী বাহিনীর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা বিদ্রোহের অবসান ঘটায়।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির ইতিহাস
স্বাধীনতার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত শুরু হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা শুধুমাত্র বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষাকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিককে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে পার্বত্য অঞ্চলে বিশৃংঙ্খলা দেখা দেয়।
চাকমা রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বা সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধি দল এবং শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনায় বসেন। তখন বঙ্গবন্ধু জোর দিয়েছিলেন যে পার্বত্য অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করবে। শেখ মুজিব আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালিদের বসতি স্থাপনের হুমকিও দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
ফলস্বরূপ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে সমস্ত আদিবাসী ও উপজাতির একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে পার্বত্য ছাত্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি (Parbatya Chhatagram Jana Shanghatti Samiti (PCJSS) প্রতিষ্ঠা করে। এই সংগঠন এর সশস্ত্র শাখা ছিল শান্তিবাহিনী যারা সরকারী নীতি প্রতিরোধের জন্য সংগঠিত হয়েছিল।
শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরায় আত্মগোপন করে নিজেদেরকে প্রশিক্ষণ ও সজ্জিত করেছিল। ১৯৭৭ সালে, তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ে তাদের প্রথম আক্রমণ চালায়।
শান্তিবাহিনী বাঙালি পুলিশ, সৈন্য, সরকারি অফিস ও কর্মচারী এবং এই অঞ্চলের বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর হামলা চালায়। বিদ্রোহের সময়, শান্তি বাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের দলকে মানবাধিকারের অপব্যবহার এবং জাতিগত নির্মূল করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য একজন জেনারেলের অধীনে একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ১৯৬২ সালে, কর্ণফুলি নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে আনুমানিক ১,০০,০০ জন স্থানীয় আদিবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাটির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৮০-এর দশকে, মেজর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই অঞ্চলে বাঙালিদের বসতি স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়। যার ফলে, অনেক আদিবাসীকে উচ্ছেদ করার অভিযোগ ওঠে এবং জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। ১৯৯১ সালে, পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮.৫ শতাংশ হয়।
১৯৮৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, জেনারেল এরশাদ জাতীয় সংসদে একটি আইন পাশ করে পার্বত্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করে। প্রত্যেক পরিষদের প্রধান ছিলেন চেয়ারম্যান, যিনি আদিবাসীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। ৩০ সদস্যবিশিষ্ট এই পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী এবং এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি। কিন্তু জেলা পরিষদ আইনের কোন সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকায় জনসংহতি সমিতি তা প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর পার্বত্য শান্তি আলোচনা শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার নতুন দফা শুরু হয়। সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকভাবে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির গুরুত্ব
চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদের অধীনে একটি আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের কাউন্সিল চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরাং এবং তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতির পুরুষ ও মহিলাদের নিয়ে গঠিত হবে।
প্রতিনিধিরা পার্বত্য অঞ্চলের জেলা পরিষদ দ্বারা নির্বাচিত হবে। পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাউন্সিলের আইন-শৃঙ্খলা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং উপজাতীয় আইন বজায় রাখার, সাধারণ প্রশাসনের তত্ত্বাবধান, দুর্যোগ ত্রাণ ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয়, শিল্পের জন্য লাইসেন্স প্রদান এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা ও দায়িত্বে থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকারকে পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কিত আঞ্চলিক পরিষদের সামগ্রিক বিষয়গুলোর সাথে পরামর্শ করতে হবে। চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কিত বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য উপজাতীয় জাতিসত্তার একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপনেরও বিধান করা হয়েছে। তবে, জেলা পরিষদগুলোর ক্ষমতা ও কার্যক্রম পূর্বের মতো থাকবে।
উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার নির্ধারিত হলে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমির উপর মালিকানা নির্ধারণের জন্য ভূমি জরিপ ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। চুক্তির অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনী মোতায়েন থাকবে, স্থায়ী সেনানিবাসও বহাল থাকবে।