বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল

বঙ্গভঙ্গ কি?

বঙ্গভঙ্গ হল ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ভারতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন কর্তৃক বাংলার বিভাজন যা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনের সূচনা তৈরি করে। ১৬ অক্টোবর, তৎকালীন বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়।
১৭৬৫ সাল থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, এবং আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু বিশাল অঞ্চলটি ১৯০০ সাল নাগাদ একক প্রশাসনের অধীনে পরিচালনা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক জটিলতা কমাতে বাংলাকে বিভাজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া নেয়।
আসাম ও পূর্ব বাংলার ১৫টি জেলা নিয়ে নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়, যার রাজধানী ছিল ঢাকা। নবগঠিত প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩১ মিলিয়ন যাদের অধিকাংশই মুসলিম। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি হিন্দুরা বঙ্গবঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় জানায় যে, বাঙলা বিভক্ত হলে, সমগ্র বিহার ও উড়িষ্যা সহ একটি প্রদেশে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। তারা এরুপ বিভাজনকে বাংলায় জাতীয়তাবাদকে শ্বাসরোধ করার একটি প্রচেষ্টা বলে মনে করেছিল। অবশেষে, হিন্দুদের প্রবল আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হন এবং সেইসাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেন।

বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল

বঙ্গভঙ্গের কারণ

বঙ্গভঙ্গের পেছনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে ছিল প্রশাসনিক সংস্কার, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনরোধ, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, মুসলমানদের দাবি এবং কংগ্রেসকে দুর্বল করা অন্যতম। নিম্মে বঙ্গভঙ্গের কারণসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করা হল।
১. প্রশাসনিক কারণ
বঙ্গভঙ্গের মূল কারণ ছিল মূলত প্রশাসনিক সংষ্কার পরিকল্পনা। বাংলা বিশাল প্রদেশ হওয়ায় এর শাসনভার ছিল কষ্টসাধ্য। বাংলার আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল। লর্ড কার্জন একে প্রশাসনিক সংস্কার নামে অভিহিত করেন।
২. রাজনৈতিক কারণ
ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্যে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। তখন এসব আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। ঢাকাকে রাজধানী করে সরকার আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে। এছাড়া ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের পেছনে আরো কয়েকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। যেমন,
ক. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করা: ১৮৮৫ সালে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ নামক একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে বিশেষ করে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সিতে’ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রতে পরিণত হয়। এ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা শহর। সুচতুর ইংরেজ সরকার এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ এবং আন্দোলনকারীদের মেরুদন্ড- ভেঙ্গে দেয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গ করতে উদ্যোগী হয়। ব্রিটিশ সরকার ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি অবলম্বন করে।
খ. ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি বাস্তবায়ন: ব্রিটিশরা প্রথম থেকেই এই উপমহাদেশে ভাগ কর শাসন কর নীতিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের শাসন ও ভোগের প্রয়োজনে যেকোন সময় বিভিন্ন প্রদেশ বিভক্ত করত।
গ. মুসলমানদের দাবি: নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগ পাবে। হিন্দু সম্প্রদায় প্রভাবিত কলকাতার উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিভর্রশীলতা হ্রাস পাবে। মুসলমানরা চাকরি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করতে পারবে।
৩. অর্থনৈতিক কারণ
বঙ্গভঙ্গের পূর্বে যাবতীয় শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্যি, অফিস-আদালত, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কলকাতার কেন্দ্রিভূত ছিল। ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সর্বত্রই পিছিয়ে পড়েছিল। অধিকাংশ মুসলমান জনগণ তখন ভাবতে শুরু করে যে, বঙ্গভঙ্গ হলে তারা অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনের সুযোগ পাবে।
৪. সামাজিক কারণ
ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের প্রতি উদারনীতি এবং মুসলমানদের প্রতি বৈরী নীতি অনুসরণ করত। মুসলমানরা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন একটি দরিদ্র, রিক্ত ও নিঃস্ব সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। সুতরাং লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গবঙ্গের চিন্তা-ভাবনা শুরু হলে পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায় স্বভাবতই এর প্রতি সমর্থন জানায়। বঙ্গবঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ তাদের হারানো প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
৫. ধর্মীয় কারণ
অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে মুসলমানগণ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিম অংশে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এ দৃষ্টিকোণ থেকেও দুই সম্প্রদায়ের জন্য দুটি পৃথক প্রদেশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
৬. কংগ্রেসকে দুর্বল করা
১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় জনগনের আন্দোলনের সুযোগ পায়। এই সংগঠনের অধীনে তারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। লর্ড কার্জন বিশ্বাস করতো কলকাতায় কিছু ষড়যন্ত্রকারী আমার বক্তব্য কংগ্রেসে প্রচার করত। কাজেই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে ষড়যন্ত্রকারীরা সে সুযোগ আর পাবে না। তারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে।

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যদিও বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সাময়িক ছিল তবুও বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় এর থেকে বেশী লাভবান হয়েছিল। নিম্মে বঙ্গভঙ্গের ফলাফল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
১. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া
বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয় ঢাকা। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানগণ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভে সক্ষম হয়। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় অট্টালিকা গড়ে ওঠায় ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানগণ তাদের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবার আনন্দে মেতে ওঠে। নবাব স্যার সলিমুলস্নাহ পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দিন ঢাকার এক জনসভায় বলেন, ‘বঙ্গভঙ্গ আমাদেরকে নিষ্ক্রিয়তার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটা আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে কর্ম সাধনায় এবং সংগ্রামে।’ অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার গণমানুষের ভাগ্যের দ্বার উন্মোচিত হয়।
২. হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
শুরু থেকেই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠিন। বাংলার হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝড় তুলেছিল। তারা একে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ হিসাবেও উল্লেখ করে।
৩. ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ
হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন মোকাবেলা করার জন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ সালে ‘মুসলিম লীগ’ নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে হিন্দু -মুসলিম সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়।
৪. উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ও সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। সমগ্র ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আত্মপ্রকাশ করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হতে থাকে।
৫. ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন
বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক প্রভাবে ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি জয়যুক্ত হয়। ফলে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ভারতের বৃহত্তম দুটি সম্প্রদায় এর ফলে চিনত্মা-চেতনার দিক থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ
বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে কলকাতা কেন্দ্রিক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার সুযোগ লাভ করে।