সামাজিকীকরণ কাকে বলে? সামাজিকীরণ এর গুরুত্ব | সামাজিকীকরণের মাধ্যম
সামাজিকীকরণ (Socialization) কাকে বলে?
মানুষ সামাজিক জীব। তাই সে সমাজ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করতে পারে না।
একজন মানুষের পূর্ণ জীবনচক্র সমাজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এ জীবন পরিক্রমায় প্রতিটি মানুষ নিজেকে ক্রমাগত সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শেখে ও খাপ খাইয়ে চলে। সমাজের উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলে, নিজের মধ্যে সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়। সমাজের ভাবধারা, রীতি-নীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হয়। ব্যক্তি মানুষের সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে ওঠার এ প্রক্রিয়াই হচ্ছে সামাজিকীকরণ বা Socialization।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া একটি জীবনব্যাপী এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া।এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ পুরোপুরি সামাজিক মানুষ হিসেবে পরিনত হয়।
এই প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস এর সংজ্ঞাটি যথার্থ – ব্যক্তি পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিনত হয়। এ প্রক্রিয়া ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব লাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে এক জন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না।”
আরনল্ড গ্রীন (Arnold Gree) এর মতে, সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি শিশু আপন সংস্কৃতির সাথে সুপরিচিত হয় এবং এভাবে তার অহংবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে।
ওয়াটসন (Watson) বলেন, বিভিন্ন সম্পর্ক, শিক্ষার মাধ্যমে এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে ব্যক্তিকে সমাজে বাস করার উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়াই হচ্ছে সামাজিকীকরণ।
নেইল জে. স্মেলসার (Neil J. Smelser) বলেন, সামাজিকীকরণ হচ্ছে সমাজে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের দক্ষতা এবং মনোভাব তোলার প্রক্রিয়া।
অগবার্ন (Ogburn) এর মতে, “সামাজিকীকরণ হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি গোষ্ঠীর নিয়ম মেনে চলতে শেখে।”
কলে (Colley) এর মতে, “সামাজিকীকরণ একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিয়মগুলি শিখার মাধ্যমে এবং অন্যের কাছ থেকে নিজের স্ব-সম্পর্কে জেনে নিজের স্বভাব বিকাশ করে।”
সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা মানব শিশু ক্রমশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।
নিম্নে সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো আলোচনা করা হলোঃ
পরিবার : সামাজিকীকরণের কতগুলো মাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে পরিবারের ভূমিকাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি কাঁচামাল জোগায়, সংস্কৃতি নকশা জোগায় এবং পরিবারে পিতা-মাতা কারিগর হিসেবে কাজ করেন। কারণ শিশুর দৈহিক, মানসিক, পার্থিব ও অপার্থিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটায় পরিবার। কীভাবে কথা বলতে হবে, নিজের আবেগ কীভাবে প্রকাশ করা যায়, তা শিশু পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে।
খেলার সঙ্গী : শিশুর সামাজিকীকরণে তার সঙ্গী বা খেলার সঙ্গীরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। শিশু তার খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে মেলামেশা করলে তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি পরিস্ফুট হয়। সে স্বাবলম্বী হতে শেখে।
ধর্ম : ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শৈশবকাল থেকে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সেই ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে লালিত হয় এবং সেই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ তথা সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়। এককথায়, ধর্মীয় আচর-অনুষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সভ্যরা যাতে সামাজিক মূল্য, সামাজিক আদর্শ, সামাজিক অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করতে পারে সেজন্য প্রত্যেক সমাজ প্রতিটি সভ্যকে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের শিক্ষাদান করে। সমাজ তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করে।
গণমাধ্যম : সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। গণমাধ্যমগুলো হলো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তবে এগুলো সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গৌণ ভূমিকা পালন করে।
মন্তব্য : বিবৃত আলোচনাকে বিচার ও বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, সামাজিকীকরণের বাহন হিসেবে পরিবার, খেলার সঙ্গী, ধর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর গণমাধ্যমগুলো সামাজিকীকরণে গৌণ ভূমিকা পালন করে।
সামাজিকীরণ এর গুরুত্ব
ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রক্রিয়ায় সামাজিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে মানুষ একটি সামাজিক ব্যক্তি হয়ে ওঠে। সঠিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে একটি সমাজের মধ্যে অভিন্নতা দেখা দিতে পারে। একটি সমাজের লোকেরা যদি একই সামাজিকীকরণ পরিবেশ পায় তাহলে সেখানকার মানুষের একই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে বেড়ে ওঠে। নিজের জীবনের নতুন পদ্ধতিতে সামঞ্জস্য করার জন্য মানুষকে জীবনের কৌশলগুলি শিখতে হয়, আর সে কৌশলগুলো সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।