সম উৎপাদন রেখার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

অর্থনীতিবিদ হিক্স ও এ্যালেন সর্বপ্রথম সম উৎপাদন রেখার ধারণা প্রদান করেন। তাঁরা প্রচলিত তত্ত্বের পরিবর্তে সম উৎপাদকের নিরপেক্ষ রেখার মাধ্যমে উৎপাদকের আচরণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যেমন নিরপেক্ষ রেখার সাহায্য নেওয়া হয় তেমনি উৎপাদকের আচরণ বিশ্লেষণ করা হয় সম উৎপাদন রেখার সাহায্যে। নিরপেক্ষ রেখা এবং সম উৎপাদন রেখা মূলত একই, শুধু উপস্থাপন পদ্ধতি আলাদা।

সম উৎপাদন রেখার বৈশিষ্ট্য

সম উৎপাদন রেখার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. সম উৎপাদন রেখা ডান দিকে নিম্নগামী

সম উৎপাদন রেখা ডান দিকে নিম্নগামী। অর্থাৎ, সম উৎপাদন রেখার ঢাল ঋণাত্মক। উপকরণের প্রান্তিক কারিগরি পরিবর্তনের হার দ্বারা সম উৎপাদন রেখার ঢাল প্রকাশ করা হয়। প্রান্তিক কারিগরি পরিবর্তনের হার দ্বারা বুঝানো হয় যে, উৎপাদকের উৎপাদন স্থির রাখার জন্য দুটি উপকরণের মধ্যে একটির নিয়োগ বাড়ালে অপরটির নিয়োগ ছাড়তে হয়। এ বিষয়টি কেবলমাত্র ডান দিকে নিম্নগামী রেখার মাধ্যমেই দেখানো সম্ভব। ভূমি বা লম্ব অক্ষের সমান্তরাল এবং ডান দিকে ঊর্ধ্বগামী রেখার মাধ্যমে সম উৎপাদন রেখার মূল বক্তব্য অর্থাৎ, বিভিন্ন সংমিশ্রণ ব্যবহার করে একই উৎপাদন পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা যদি লম্ব অক্ষের সমান্তরাল সম উৎপাদন রেখা বিবেচনা করি, তাহলে নির্দিষ্ট পরিমাণ L এর সাথে K এর পরিমাণ বাড়িয়ে উৎপাদক বেশি উৎপাদন পেতে পারে। আবার এখানে K বাড়ানোর জন্য L এর সামান্য পরিমাণও ছাড়তে হয় না।

১. সম উৎপাদন রেখা ডান দিকে নিম্নগামী

আবার আমরা যদি ভূমি অক্ষের সমান্তরাল সম উৎপাদন রেখা বিবেচনা করি, তাহলে K কে স্থির রেখেই L এর পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। এক্ষেত্রে K এর পরিমাণ কমাতে হয় না। আবার এক্ষেত্রে e বিন্দুর তুলনায় f বিন্দুতে উৎপাদন বেশি হতে পারে।

সম উৎপাদন রেখা ডান দিকে নিম্নগামী

আবার আমরা যদি ডান দিকে ঊর্ধ্বগামী সম উৎপাদন রেখা বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনের জন্য দুটি উপাদানই বর্ধিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। যা সম উৎপাদন রেখার মূলবক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুধু ৰাম থেকে ডান দিকে নিম্নগামী সম উৎপাদন রেখার মাধ্যমেই সম উৎপাদন রেখার মূলবক্তব্য উপস্থাপিত হতে পারে।

সম উৎপাদন রেখা ডান দিকে নিম্নগামী

২. সম উৎপাদন রেখা কেন্দ্রের দিকে উত্তল

সম উৎপাদন রেখার ঢাল দুটি উপকরণের প্রান্তিক কারিগরি পরিবর্তনের হার প্রকাশ করে। একটি উপকরণ নিয়োগের একক বাড়ানো হলে অপরটি প্রথম দিকে যে হারে ছাড়া হয়, পরবর্তীতে সে ছাড়ার হার (MRTS) কমে যায়। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট সম উৎপাদন রেখার বাম দিক থেকে ডান দিকে গেলে উপকরণের প্রান্তিক বিকল্পনের হার ক্রমহ্রাসমান হয়। সে ক্রমহ্রাসমান MRTS এর কারণে সম উৎপাদন রেখা কেন্দ্রের দিকে বা মূলবিন্দুর দিকে উত্তল হয়।

সম উৎপাদন রেখা কেন্দ্রের দিকে উত্তল

চিত্রে MRTS এর ক্রমহ্রাসমানতা দেখানো হয়েছে। চিত্রে A থেকে B তে L উপাদানের এক একক বাড়ানোর জন্য K প্রাথমিকভাবে বেশি ছাড়া হয়েছে। তাই A থেকে B পর্যন্ত IQ বেশি খাড়া। তারপর B থেকে C তে L এর এক একক বাড়ানোর জন্য K এর পূর্বের তুলনায় কম ছাড়া হয়। ফলে IQ পূর্বের চেয়ে কম খাড়া হয়ে নামে। তারপর C থেকে D তে L উপাদানের এক একক বাড়ানোর জন্য K আরো কম ছাড়া হয়। ফলে IQ পূর্বের চেয়ে আরো কম খাড়া হয়ে নামে। এভাবে A থেকে B, B থেকে C এবং C থেকে D তে IQ নেমে আসার প্রকৃতি থেকে বলা যায়, সম উৎপাদন রেখা কেন্দ্রের/মূলবিন্দুর দিকে উত্তল।

৩. সম উৎপাদন মানচিত্রের উচ্চতর সম উৎপাদন রেখা অধিক উৎপাদন নির্দেশ করে

দুটি অক্ষের মধ্যে যখন একাধিক সম উৎপাদন রেখা পর পর দেখানো হয় তখন তাকে সম উৎপাদন মানচিত্র বলে। সম উৎপাদন মানচিত্রের উপরের দিকে সম উৎপাদন রেখায় উৎপাদক বেশি উৎপাদন পায়।

সম উৎপাদন মানচিত্রের উচ্চতর সম উৎপাদন রেখা অধিক উৎপাদন নির্দেশ করে

মনে করা যাক, IQo, IQ1, IQ2 তিনটি সম উৎপাদন রেখা। এ তিনটি রেখায় যথাক্রমে Qo, Q1, এবং Q2, উৎপাদন নির্দেশ করে। এখানে IQo থেকে IQ1 এবং IQ1 হতে IQ2 তে বেশি উৎপাদন হয়। কারণ, উপরের সম উৎপাদন রেখায় অধিক পরিমাণ শ্রম (L) ও মূলধন (C) নিয়োগ করা হয়। তাই উপরের নিরপেক্ষ রেখায় উৎপাদনও বেশি হয়। তাই এখানে Q2 > Q1 > Qo। কারণ, দুটি উপকরণের কম পরিমাণ অপেক্ষা বেশি পরিমাণে উৎপাদন অবশ্যই বেশি হবে।

৪. দুটি সম উৎপাদন রেখা পরস্পরকে ছেদ করে না

দুটি সম উৎপাদন রেখা কখনো পরস্পরকে ছেদ করে না। যদি ছেদ করে তাহলে কি অবস্থা হতে তা আমরা নিম্নের চিত্রের মাধ্যমে দেখতে পারি।

দুটি সম উৎপাদন রেখা পরস্পরকে ছেদ করে না
IQo সম উৎপাদন রেখায় দুটি বিন্দু e এবংf বিবেচনা করি। এ দুটি বিন্দু থেকে উৎপাদক সম পরিমাণ উৎপাদন Qo লাভ করে। IQ1 তে e এবং g বিন্দু বিদ্যমান। e এবং e থেকে উৎপাদক Q উৎপাদন লাভ করে। যদি IQo সম উৎপাদন রেখায় e =f হয় এবং IQ সম উৎপাদন রেখায় e = g তাহলে গাণিতিক নিয়ম অনুসারে f = g হতে হবে। অর্থাৎ, f এবং g বিন্দুতে একই উৎপাদন পাবার কথা। কিন্তু g বিন্দুতে দুটি উপকরণের পরিমাণ বেশি, তাই এখানে উৎপাদনও বেশি। ফলে e বিন্দুতে দুটি সম উৎপাদন রেখা পরস্পরকে ছেদ করায় অসংগতি দেখা দিয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি, দুটি সম উৎপাদন রেখা কখনো পরস্পরে ছেদ করতে পারে না।

৫. সম উৎপাদন রেখার কোন ব্যপ্তি নেই

সম উৎপাদন মানচিত্রে IQ পরস্পর সমান্তরাল হতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সম উৎপাদন মানচিত্র নিম্নরূপ হতে পারে, পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, IQ1, IQ2, এবং IQ3 সম উৎপাদন রেখাগুলো পরস্পর সমান্তরাল নয়।

সম উৎপাদন রেখার কোন ব্যপ্তি নেই

৬. সম উৎপাদন রেখার ঘনত্ব অসীম

সম উৎপাদন রেখার অবস্থান খুবই ঘন। অর্থাৎ, দুটি সম উৎপাদন রেখার মধ্যে তৃতীয় একটি সম উৎপাদন রেখা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অঙ্কন করা যায়। এর অর্থ সম উৎপাদন রেখার সাথে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন অপেক্ষক অবিচ্ছিন্ন।

সম উৎপাদন রেখার ঘনত্ব অসীম

চিত্রানুযায়ী, Q1 এবং Q3 এ দুটি সম উৎপাদন রেখার মধ্যে Q2 সম উৎপাদন রেখা অঙ্কন করা যায়। আবার Qo এবং Q2 সম উৎপাদন রেখার মধ্যে Q1 সম উৎপাদন রেখা অঙ্কন করা যায়। এভাবে সম উৎপাদন রেখাসমূহ পরস্পর অতি কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সম উৎপাদন রেখার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যা এ রেখাকে অন্য সব রেখা থেকে পৃথক করে।

Similar Posts