জাতীয়তাবাদ কি । জাতীয়তাবাদের উৎপত্তির ইতিহাস
জাতীয়তাবাদ কি
জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা। এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা কঠিন কেননা পন্ডিতগণ জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। মার্কসবাদীরা মনে করেন শ্রেণি শোষণের ফলে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে বঞ্চিতের ঐক্যবোধ’ থেকে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে। আবার, অন্যেরা মনে করেন সুদীর্ঘকাল ধরে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে আমরা যে সম্প্রদায়গত জীবনে এসে পৌঁছেছি সে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ‘ঐক্যবোধ’ গড়ে ওঠে তাই জাতীয়তাবাদ। কিন্তু এ ধারণাও অসম্পূর্ণ। কেননা একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও বিশ্বের বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে থেকেও মানুষ ঐক্যবোধ করতে পারে। তবে জাতীয়তাবাদকে উপলব্ধি করার জন্য কতিপয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জে. এইচ. হায়েস এর মতে Natisonalism consists of modern emotional fusion and exaggaration of two very old phenomena-nationality and patriontism”. অর্থাৎ তিনি জাতীয়তাবাদ জাতীয়তা ও দেশপ্রেম থেকে উদ্ভূত আবেগের আধুনিক প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। আবার হ্যানস কোর মতে, Nationalism is the first and foremost a state of mind, an act of consciousness. অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ মূলত: মনন ও চেতনার বহিঃপ্রকাশের সাথে সম্পর্কীত । অধ্যাপক লাস্কির মতেও জাতীয়তাবাদ মানসিক বিষয় যে মানসিকতা একদল মানুষকে মানবসমাজের অপরদল থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে। অধ্যাপক স্নাইডার জাতীয়তাবাদের একটু স্বচ্ছ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের এক বিশেষ স্তরে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্ম চেতনার ফল। তার মতে, জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার জন্য নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে বসবাস করা জরুরী। কেননা, একই ভূ-খন্ডে বহুদিন পাশাপাশি বসবাস করলে পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় একধরনের মানসিক ঐক্য গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। স্নাইডারের মতে, Nationalism is a product of political, economic, social and intellectual factors at a certain stage of history, is a condition of mind, feeling or sentiment of a group of people living in a well-defined geographical area. সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জাতীয়তাবাদ একটি চেতনাগত ব্যাপার যার সাথে জড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বিষয়। জাতীয়তাবাদ কোন জনগোষ্ঠীকে ‘জাতিতে’ পরিণত করে। অন্যকথায় কোন জনগোষ্ঠী তখনই একটি জাতিতে পরিণত হয় যখন তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ বা ‘জাতীয়তাবোধ’ জাগ্রত হয়। অধ্যাপক বার্জেসের মতে, জাতি বলতে কোন ভূখন্ডে বসবাসকারী এবং বংশগতভাবে ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকে বোঝায়।
জাতীয়তাবাদের উপাদান
বিভিন্ন দেশে বা ভৌগোলিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন কারণে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। ঊনিশ-বিশ কিংবা ত্রিশের দশকে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানীতে যে চরম জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল তার মূলে ক্রিয়াশীল ছিল নৃ-তাত্ত্বিক আভিজাত্যের ধারণা। একই সময়ে ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে ধর্মভিত্তিক ‘দ্বি-জাতি’ ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছিল; যদিও তা পরবর্তীতে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান ১৯৪৭ সালে দুটো রাষ্ট্রে বিভক্ত হলেও তা আজ ৩টি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেকটি অংশেই আজ উভয় জাতির লোকেরা বসবাস করেছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যারা বসবাস করেছে তারা মূলত: সবাই ইউরোপীয়, এশীয় কিংবা আফ্রিকার অভিবাসীদের অধঃস্তন পুরুষ। বহু জাতির সমন্বয়ে তারা আজ আমেরিকান জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। মার্কিন জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল একই রাষ্ট্রীয় শাসনের অধীনে বসবাস। ১৮১২ সালে যখন বৃটেনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ হয় তখন ফরাসী সমর্থক জেফারসনীয়ান কিংবা বৃটিশ সমর্থক হেমিল্টনিয়ানগণ রাষ্ট্রিয় স্বার্থে আমেরিকান জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৩৯-৪৫ সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান জার্মানগণ . তাদের পূর্বপুরুষের পবিত্র ভূমি জার্মানীর বিরুদ্ধে জীবনদান করেছিল । প্যান-জার্মানিজম ‘জার্মান-আমেরিকানদের’ প্যান- আমেরিকান অনুভূতি থেকে বিরত করতে পারেনি। বাংলাদেশে যারা দ্বি-জাতিতত্ত্বের পক্ষে লড়াই করে পাকিস্তান অর্জন করেছিলেন তারা ১৯৫২ সালে ভাষার প্রশ্নে দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ছুঁড়ে ফেলে মাতৃভাষা বাংলার স্বপক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাষার প্রতি মমত্ববোধ বাংলাভাষী পূর্ববাংলার জনগণকে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল । সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদের উপাদান বহু ও বিচিত্র। ভাষা, ধর্ম, নৃ-তাত্ত্বিক গড়ন, একই ভূখন্ডে বসবাস প্রভৃতি যে কোন একটি কারণে কিংবা একাধিক কারণে কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হতে পারে। আর যখন এ ঐক্যবোধ তাদের ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হয় তখন যে কারণে এ দৃঢ় মানসিক ঐক্যের সৃষ্টি হলো। তাকেই আমরা বলি উক্ত জাতীয়তাবাদের উপাদান। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে উপাদান হল ভাষা ও সংস্কৃতি ।
জাতীয়তাবাদের উৎপত্তির ইতিহাস
জাতীয়তাবাদ মূলত: আধুনিক ধারণা হলেও প্রাচীন ও মধ্যযুগেও একধরনের জাতীয়তাবাদের উপস্থিতি ছিল। প্রাচীনকালে গ্রীকদের মাঝে এবং হিব্রুভাষীদের মাঝে এ ধরনের অনুভূতির বহি:প্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছে। গ্রীক লেখনি থেকে জানা যায় যে তারা নিজেদেরকে পৃথিবীর অপরাপর জাতিসমূহ থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতো। এমনকি এথেন্স ও স্পার্টা নগরীর জনগণ যুগ যুগ ধরে তাদের পৃথক সত্তা ও আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য পরষ্পরের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছিল।
রোমান শাসনামলে এবং রোমের পতনের পরও ‘খ্রীষ্টধর্মকে’ জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ধরে সাম্রাজ্য গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল কয়েক শতক ব্যাপী। মধ্যযুগে ইউরোপীয়গণ কয়েক শতকব্যাপী মুসলমানদের পেছনে যে ক্রসেড পরিচালনা করেছিল তাতে ‘খ্রীষ্টধর্মকে’ তারা তাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিল । তবে রেনেসাঁর (১৪৫৩ খ্রি:) পর ইউরোপীয় সমাজে বহুদিন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কোন উত্থান দেখা যায়নি। এসময় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত বিকশিত হতে শুরু করে। রেনেসাঁর পর ইউরোপের দেশে দেশে ‘ল্যাটিন’ ভাষার পরিবর্তে ‘মাতৃভাষার’ মাধ্যমে জ্ঞানচর্চ্চার রূপটি যে জোয়ার সৃষ্টি হয় তাতে প্রকৃত দেশাত্মবোধ দানা বাঁধতে থাকে। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকলে শক্তিমান শাসকের অধীনে দেশে দেশে নিজস্ব জাতীয় সত্তার বিকাশ ঘটে। এধরনের জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘ম্যাকিয়াভেলীর, দর্শন অনুঘটকের কাজ করেছে। তবে তারপরও এ ধরনের জাতীয়তাবাদী ধারণাকে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ প্রকৃত জাতীয়তাবাদ বলে স্বীকৃতি দিতে পারেননি। কেননা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশের শাসনকর্তাগণ তাদের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য না দিয়েই রাষ্ট্রিয় ভূ-খন্ড অপর রাষ্ট্রের সাথে বিনিময় করতে পারতেন। অবশেষে ১৭৭২ সালে পোল্যান্ড বিভক্তির সময় যে প্রবল গণপ্রতিবাদের সৃষ্টি হয় তাতে বিশ্ব প্রকৃত জাতীয়তাবোধের দৃষ্টান্ত অবলোকন করে। এরপর থেকে বিশ্বের চিন্তাবিদগণ জনগণের ইচ্ছার মূল্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব ‘জনতার ইচ্ছার জয়’ কেই প্রতিষ্ঠা করে। ফরাসী বিপ্লব স্বৈরাচারী শাসকের কর্তৃত্বের পরিবর্তে জনগণের সার্বভৌমত্বের বাণী প্রচার করে ।
এরপর পৃথিবী জাতীয়তাবাদের এক নতুন রূপ প্রত্যক্ষ করে ইতালী ও জামার্নীতে। ম্যাটতিনি ছিলেন ইতালীয় দেশপ্রেমিক। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ইতালী জাতিকে বুঝাতে সক্ষম হন যে একই ঐতিহ্য ও আচার-প্রথার মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে বেড়ে ওঠার ফলে ইতালীয়গণ একটি পৃথক জাতিতে পরিণত হয়েছে। তার মতে, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কারণে ইতালী জাতি পৃথিবীর অপরাপর জাতি থেকে শ্রেয়তর। অপরদিকে জার্মান দার্শনিক ফিটে প্রচার করেন যে, জার্মান জাতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। এর ফলে ইতালী ও জার্মানীতে স্বজাত্যবোধ বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে ‘জাত্যাভিমান’ বিকশিত হয়। এর সুযোগ গ্রহণ করে ইতালীতে মুসোলিনী ও জার্মানীতে হিটলারের মত একনায়কের উত্থান ঘটে যারা পুরো মানব সভ্যতাকেই হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে যে ভার্সাই সন্ধি রচিত হয়েছিল তাতে ইউরোপকে অনেকটা জাতীয়তার সংজ্ঞায় বিন্যস্ত করা হয়েছিল। চেক, স্লাভ ও পোল জাতিকে জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রদান করা হল । কিন্তু এর ফল হলো উল্টো। ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি থেকেই হিটলার ও মুসোলিনী যথাক্রমে ইতালী ও জার্মান জাতিকে এক ভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৌভাগ্যবশত: মিত্রশক্তি জয়লাভ করায় হিটলার ও মুসোলিনীর আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের কবল থেকে বিশ্বসম্প্রদায় রক্ষা পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রবল আন্দোলন শুরু হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় প্রায় ডজনখানিক রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। এসময় ভারতবর্ষে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু একদিকে জাতীয়তাবাদের অপরিপুষ্ট অবস্থা, অপরদিকে কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের অবাঙালী নেতৃত্বের কুটচালে সে উদ্যোগ সফল হয়নি। ফলে বাংলাকে বিভক্ত করে ফেলা হয়। অবিভক্ত বাংলার মূল অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তানী শাসকদের শোষণমূলক শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববাংলার লোকদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণা পরিপুষ্টি লাভ করে । যার ফলশ্রুতিতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ।