HISTORY
1 min read

পদ্মা সেতুর একটি গভীর ইতিহাস রয়েছে

পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান, পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কত, পদ্মা সেতুর পিলার কয়টি

পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান

পদ্মা সেতু হচ্ছে আমাদের দেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু ।এ পদ্মা সেতুর দিয়ে আমরা মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে।এই পদ্মাসেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়।পদ্মা সেতুটি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে টোল প্রদান করে প্রথমবারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুতে আরোহন করেন এবং এর মাধ্যমে সেতুটি উন্মুক্ত করা হয় | পদ্মা সেতুটি দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। এই পদ্মা সেতুটি পদ্মা ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।

এই পদ্মা সেতুর প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করবে- মুন্সীগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট / উত্তর পাড়), শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জঞ্জিরা / দক্ষিণ পাড়)। এ পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর। নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ভাড়ার ভিত্তিতে আগামী ছয় বছরে অধিযাচন করা হবে।

আমাদের এই পদ্মা সেতুর একটি গভীর ইতিহাস রয়েছে।

আমাদের এই পদ্মা সেতুটি ১৯৯৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, সরকার রাজধানী ও দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য ৩,৬৪৩.৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করে। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া উক্ত সেতুটিকে দেশের সম্ভাব্য দীর্ঘতম সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রস্তাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০০৪ সালের জুনে শেষ করার কথা জানানো হয়। নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত টাকার ২৬৯৩.৫০ কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে এবং ৭৫০ কোটি টাকা জাতীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তারপরে ১৯৯৯ সালের মে মাসে উক্ত সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরে ৮ম সাধারণ নির্বাচনের পর, পরবর্তী সরকারের পরামর্শক কমিটি ১. পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্ট, ২. দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্ট, ৩. মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট এবং ৪. চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ পয়েন্টে প্রাক-বাস্তবায়নযোগ্যতার সমীক্ষা করায়। ২০০৪ সালে জাইকা নিয়োজিত পরামর্শক নিপ্পন কোয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণকল্পে বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর আগের নির্ধারিত মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টেই সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

 

২০০৬-২০০৭ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ সেতু নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা পাবার জন্য আলোচনা শুরু করে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০০৭ সালের ২০ অগাস্ট তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার একনেকের বৈঠকে ১০,১৬১ কোটি টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তখন ২০১৫ সালের মধ্যে সেতুটি নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এই জন্য সেই বছর পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা প্রণয়নে দরপত্রও আহ্বান করা হয়।

তারপর ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তখন ২০১১ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা জানানো হয়। এই জন্য ২০০৯ সালে নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয় ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক অর্থ যোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

তারপর আমাদের বাংলাদেশের সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ সালের এপ্রিলে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে প্রকল্পের জন্য প্রাকযোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনা অনুসারে প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করবে: মুন্সীগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট/উত্তর পাড়), শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জঞ্জিরা/দক্ষিণ পাড়)। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করলেও, তারপর আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ও ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়ায় সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

তারপর ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে এসে বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। একই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে সরকারের ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি হয়। ২০১১ সালের ১০ অক্টোবরে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের নামও দুর্নীতির অভিযোগের সাথে যুক্ত হয়। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় ও ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

২০১২ সালের ২৯ জুন সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দরপত্রে অংশ নেওয়া এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক ঋণচুক্তিটি বাতিল করে। পরে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও তার প্রতিশ্রুত ঋণচুক্তি বাতিল করে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলেন। ৮ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা সংসদে পেশ করেন তিনি। ২০১২ সালের ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে ২৩ জুলাই তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও ২৪ জুলাই সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে ওএসডি করা হয়। সরকারের অনুরোধে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে পুনরায় সম্পৃক্ত হতে রাজি হলেও তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থায়ন করতে অসম্মতি জানায়। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় দুদক। গ্রেপ্তার করা হয় আরও দু’জনকে। ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি।

২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ আর নেওয়া হবে না সরকার এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ২০১৩ সালের ২৬ জুন আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।

২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ২০১৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর দুদক জানায় পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। ২৬ অক্টোবর পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার অবসান হয়। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।

Rate this post