শবে কদর সম্পর্কে হাদিস

শবে কদর একটি পূর্ণময় রজনীর অন্যতম নাম হচ্ছে শবে কদর এ রাত্রিতে হাজার হাজার ফেরেশতা আসমান হতে দুনিয়ার নেমে আসে এবং মুমিনদের জন্য দোয়া করতে থাকে। আল্লাহ তাআলা এ রাত্রিকে সম্মানিত ও ফজিলত পূর্ণ করেছেন। এ রাত্রিতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাত্রি কে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। হাদিসের গ্রন্থে বিভিন্ন হাদিস বর্ণিত হয়েছে শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে আজকে আমরা সেই অসংখ্য হাদিস গুলোর মধ্য থেকে অল্প কয়েকটি হাদিস আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ১

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বাণী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির উল্লেখ করে বলেনঃ “ঐ লোকটি .এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর পথে অস্ত্র ধারণ করেছিল অর্থাৎ জিহাদে অংশ নিয়েছিল।” মুসলমানরা এ কথা শুনে বিস্মিত হওয়ায় আল্লাহ তা’আলা এ সূরা অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দেন যে, লায়লাতুল কদরের ইবাদত ঐ ব্যক্তির এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, বানী ইসরাঈলের একটি লোক সন্ধ্যা হতে সকাল পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং দিনের বেলায় সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্বীনের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতেন। এক হাজার মাস পর্যন্ত তিনি এই ভাবে কাটিয়ে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা এই সুরা অবতীর্ণ করে তাঁর প্রিয় নবী (সঃ)-এর উম্মতকে সুসংবাদ দেন যে, এই উম্মতের কোন ব্যক্তি যদি লায়লাতুল কাদরে ইবাদত করে তবে সে বানী ইসরাঈলের ঐ ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক পুণ্য লাভ করবে।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ২

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আলী ইবনে উরওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাণী ইসরাঈলের চারজন আবেদের কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা আশি বছর পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ক্ষণিকের জন্যে তারা আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তাঁরা। হলেন হযরত আইউব (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ), হযরত হাকীল ইবনে আ’জয় (আঃ) এবং হযরত ইউশা ইবনে নুন (আঃ)। সাহাবীগণ (রাঃ) এ ঘটনা শুনে খুবই অবাক হলেন। তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বললেনঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আপনার উম্মত এই ঘটনায় বিস্ময়বোধ করেছেন, জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তা’আলা আপনার উপর এর চেয়েও উত্তম জিনিষ দান করেছেন। আপনার উম্মত যে ব্যাপারে বিস্মিত হয়েছে এটা তার চেয়েও উত্তম।” তারপর তিনি তাঁর কাছে এই সূরাটি পাঠ করলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত খুশী হলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ লায়লাতুল কাদরের ইবাদত, নামায, রোযা ইত্যাদি পুণ্যকর্ম এক হাজার মাসের লায়লাতুল কাদর বিহীন সময়কালের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। তাফসীরকারগণও এরকমই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) লায়লাতুল কাদর বিহীন সময়ের এক হাজার মাসের চেয়ে একটি লায়লাতুল কদর উত্তম বলে মত প্রকাশ করেছেন। একথাই যথার্থ, অন্য কোন কথা সঠিক নয়।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ৩

মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রমাযান মাস এসে গেলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেন “(হে জনমণ্ডলীঃ) তোমাদের উপর রমাযান মাস এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকত পূর্ণ বা কল্যাণময়। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসের কল্যাণ হতে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হয় সে প্রকৃতই হতভাগ্য। সুনানে নাসাঈতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রিতে ইবাদত করে, তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মার্জনা করে দেয়া হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ৪

আবু দাউদ তায়ালেসী (রাঃ) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ লায়লাতুল কদর সাতাশতম অথবা উনত্রিশতম রাত্রি। এই রাত্রে ফেরেশতারা পৃথিবীতে প্রস্তর খণ্ডের সংখ্যার চেয়েও অধিক সংখ্যায় অবস্থান করেন।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ৫

হযরত কাতাদা (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এ রাত্রে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করে। কোন অকল্যাণ বা অনিষ্ট সকাল পর্যন্ত এ রাত্রিকে স্পর্শ করতে পারে না।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ৬

মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “(রযমান মাসের) শেষ দশ রাত্রির মধ্যে। লায়লাতুল কদর রয়েছে। যে ব্যক্তি এই রাত্রে সওয়াবের আশায় ইবাদত করে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মার্জনা করে দেন। এটা হলো বেজোড় রাত্রি। অর্থাৎ একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ ও উনত্রিশতম রাত্রি।”

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ৭

একটি সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, বান্দা নিজের পাপের কারণে, আল্লাহর দেয়া রিক থেকে বঞ্চিত হয়। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, কাদরের রাত্রি তুলে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ হলোঃ কদরের রাত নির্ধারণের জ্ঞান তুলে নেয়া হয়েছে। কদরের রাত্রিই যে তুলে নেয়া হয়েছে এমন নয়, কিন্তু অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায় বলে যে, কদরের রাত্রিই তুলে নেয়া হয়েছে। কদরের রাত্রি যে তুলে নেয়া হয়নি তার বড় প্রমাণ হলো এই যে, উপরোক্ত কথার পরই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “লায়লাতুল কদর রমযানের শেষ দশকের নবম, সপ্তম এবং পঞ্চম রাত্রে তালাশ করো।” নবী করিম (সঃ) যে বলেছেনঃ “লায়লাতুল কদরের নির্ধারণ সম্পর্কিত জ্ঞান তুলে নেয়ার মধ্যে সম্ভবতঃ তোমাদের জন্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর ভাবার্থ হলো এই যে, এই রাত্রি সন্ধানকারী সম্ভাব্য সমস্ত রাত্রে ভক্তি বিনয়ের সাথে ইবাদত করবে। আর এই রাত্রি নির্ধারিত হয়ে গেলে শুধু ঐ রাত্রেই ইবাদত করবে। আর এই রাত্রি নির্ধারণ না করার মধ্যে বিজ্ঞানময় আল্লাহর হিকমত এই যে, এর ফলে এই রাত্রি পাওয়ার আশায় পবিত্র রমান মাসে বান্দা মন দিয়ে ইবাদত করবে এবং রমযানের শেষ দশকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ইবাদতের কাজেই নিয়োজিত করবে।

শবে কদর সম্পর্কিত হাদিস ৮

নবী করীম (সঃ)ও ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রত্যেক রমযান মাসের শেষ দশকে ই’তেকাফ করতেন। তার ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মীরা উক্ত সময়ে ই’তেকাফ করতেন। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ৯

হযরত ইবনে উমারের (রাঃ) বর্ণনায় রয়েছে। যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) রমযানের শেষ দশকে ই’তেকাফ করতেন।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ৯

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, রমযানের দশদিন বাকি থাকার সময়েই রাসূলুল্লাহ (সঃ) সারা রাত্রি জেগে কাটাতেন এবং গৃহবাসীদেরকেও জাগাতেন এবং কোমর কষে নিতেন (অর্থাৎ ইবাদতের জন্যে উঠে পড়ে লেগে যেতেন) (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস  ১০

সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই সময়ে যেরূপ পরিশ্রমের সাথে ইবাদত করতেন অন্য কোন সময়ে সেরূপ পরিশ্রমের সাথে ইবাদত করতেন না। কোমর বেঁধে নিতেন বা কোমরে তহবন্দ বাঁধতেন এর ভাবার্থ এই যে,ইবাদতে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। এর অর্থ এও হতে পারে যে, তিনি ঐ সময়ে স্ত্রী সহবাস করতেন না। আবার উভয় অর্থও হতে পারে। অর্থাৎ ঐ সময়ে তিনি স্ত্রীদের সাথে সহবাস করতেন না। এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ইবাদত করতেন।

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ১১

মুসনাদে আহমদে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন রমযান মাসের দশ দিন বাকী থাকতো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তহবন্দ বেঁধে নিতেন এবং স্ত্রীদের সংস্পর্শ হতে দূরে থাকতেন।

 

ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, রমযানের শেষ দশ রাতে লায়লাতুল কাদরকে সমান গুরুত্বের সাথে তালাশ করতে হবে। কোন রাতকে কোন রাত্রের উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, সব সময়েই তো দূআর আধিক্য মুসতাহাব, তবে রমযান মাসে দু’আ আরো বেশী করে করতে হবে, বিশেষ করে রমযানের শেষ দশকে এবং বেজোড় রাত্রে। নিম্নের দু’আটি খুব বেশী পাঠ করতে হবেঃ (اللهم انك عفو كريم تحب العفو فاعف عني) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে আপনি ভালবাসেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন!”

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস ১২

মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আমি কদরের রাত্রি পেয়ে যাই তবে আমি কি দু’আ পাঠ করবো? উত্তরে তিনি বললেনঃ (اللهم انك عفو كريم تحب العفو فاعف عني) এই দু’আটি পাঠ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসায়ীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহতেও এটা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন। মুসতাদরাকে হাকিম গ্রন্থেও এটা বর্ণিত হয়েছে)

শবে কদর সম্পর্কে হাদিস শেষ কথা

হাদিসের গ্রন্থগুলোতে শবে কদর সম্পর্কে অনেক হাদিস উল্লেখিত হয়েছে এ হাদীসগুলোর মূল বিষয় হলো শবে কদর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রজনী এ রজনীতে অনেক বেশি বেশি নফল ইবাদত করা উত্তম এবং ওই শবে কদরের ফজিলত পেতে চাইলে রমজানের শেষ 10 দিন খুব গুরুত্বের সাথে প্রতি রাত্রে ইবাদত করতে হবে তাহলে আমরা শবে কদর পেতে পারবো বিশেষ করে বিজর রাত্রিগুলোতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রত্যেক রমজানের শেষ দশকে বিশেষভাবে বিজর রাত্রিতে বেশি বেশি ইবাদত করে শবে কদর লাভ করার মত তৌফিক দান করুন আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *