২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস | ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস | ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আসছালামু আলাইকুম সম্মানিত পাঠকবৃন্দ সবাইকে আমাদের ওয়েবসাইটে স্বাগতম। আসা করি সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। প্রিয় পাঠক আজকে আমরা তোমাদের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো। আসা করি যারা ২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস জানেন না তারা জেনে নিবেন।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস

আমরা জানি আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে  ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারী কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। তবে এটি নিয়ে যারা কাজ করেছিলেন, জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাঁদের যে দীর্ঘ এবং কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টা ছিল সে সম্পর্কে কমজন‌ই জানেন। ভাষা শহিদদের সঙ্গে সঙ্গে যারা ২১শে ফেব্রুয়ারীর ইতিহাসকে বিশ্ব দরবারে স্থান করে দেয়ার জন্য  অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা। আর একটি জিনিস না বললেই না। সেটি হল পোস্টটি লিখছি আমি,কিন্তু পি কে ডি তাঁর বন্ধু হাফিজুর জাহাঙ্গীর ভাই এর থেকে তথ্যগুলো যোগাড় করে দিয়েছিল। তাই এটি পড়ে যদি আপনারা গর্ববোধ করেন ( করবেন অবশ্যই) এবং এর কুশীলবদের প্রতি যখন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন, পি কে ডিও সামান্য একটু ধন্যবাদ পেতে পারে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি তার মমতা এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে যত আন্দোলন সংগ্রামে যাঁরা শহিদ হয়েছে বা সন্মুখ সারিতে ছিলেন  তাঁদের প্রতি পি কে ডি অন্যরকমের ভালোবাসা লালন করে নিজের অন্তরের গভীর থেকে গভীরতম অংশে। সেই তাগিদেই তার এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে ছিল অশেষ আগ্রহ। পি কে ডি নিজে একজন শহিদের সন্তান।

’৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠার কাহিনি বলার আগে ভাষা সম্পর্কে দুই একটা কথা বলে নিই। স্রষ্টার মহান সৃষ্টি হিসাবে মানবজাতি অন্যান্য প্রাণী থেকে ভিন্ন হয় বিশেষত ভাষার কারণে। মানুষ কথা বলতে পারে। গাছ লতাগুল্ম, পশুপাখি যে ভাষায় তাদের ভাব বিনিময় করে তা সংজ্ঞায়িত ভাষার পর্যায়ে পড়ে না। বিভিন্ন জাতিসত্তার মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম হল তার মুখের ভাষা। সেটি আবার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।তবু যে কোন মানুষ চেষ্টা করলে অন্য ভাষাও আয়ত্ত করতে পারে।কিন্তু পশুকুলের সাথে যদি তুলনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই কুকুরের ডাক বিড়াল দিতে পারে না। অথবা সিংহের মত গর্জন বিশালদেহী জলহস্তী করতে পারে না। তাই মনুষ্য জাতি সৃষ্টির সেরা জীব।

মানুষের ভাষার সংজ্ঞা দেয়া খুব সহজ নয়। কেননা যে কোন বিষয়ে সংজ্ঞা দিতে হলে ভাষার প্রয়োজন হয়। তবে ভাষার একটি সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যেতে পারে যে ভাষা হল মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করতে পারে। মানুষে মানুষে যোগাযোগে ভাষা হল অন্যতম মাধ্যম। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ভাষা বাগযন্ত্রের (কন্ঠনালী, মুখবিহ্বর, কন্ঠ, জিহবা, তালু, দাঁত, নাক , ঠোঁট ইত্যাদি) মাধ্যমে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করে। এই ভাষা বিভিন্ন জাতির , বিভিন্ন অঞ্চলের ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন , বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথায় বলে। আবার  এই দেশেই বসবাসকারী অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাঁদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিকী ভাষা।হাত ও বাহুর এবং শারীরিক ভঙ্গীর মাধ্যমে  ভাব প্রকাশ করার পদ্ধতিকে প্রতীকী ভাষা বলা যায়।

ভাষাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পৃথিবীব্যাপী ভাষা সম্পর্কে কতগুলো সাযুজ্য বের করেছেন যা নিম্নে দেয়া হলঃ

১) যেখানেই মানুষ আছে ,সেখানেই ভাষা আছে। আদিম ভাষা বলে কিছু নেই।ভাষা সবসময়‌ই পরিবর্তনশীল।

২) মানুষের সব ভাষাই সমান জটিল এবং মহাবিশ্বের যে কোন ধারণা প্রকাশে সক্ষম।

৩) যেকোন ভাষার শব্দভান্ডারকে নতুন ধারণা প্রকাশের সুবিধার্থে নতুন শব্দগ্রহণ করে সমৃদ্ধ করা হয়।

৪) সব ভাষাই সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়।

৫) প্রায় প্রতিটি ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজস্ব ব্যাকরণ রয়েছে।

বাংলা হল পৃথিবীর ৭ম বৃহৎ ভাষা।বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি।বাংলা ভাষাভাষীরা থাকে বাংলাদেশে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে , ত্রিপুরা , উড়িষ্যা, বিহার এবং আসামের কিছু অংশে।তবে বাংলাদেশী বাঙালি এবং ভারতীয় অভিবাসী বাঙালিদের কারণে পৃথিবীর  অনেক দেশেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে। ভাষা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। তবে এই স্বল্প পরিসরে আপাতত বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা উপমহাদেশটিকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি দেশে বিভক্ত করে প্রায় দুইশত বৎসরের শাসনক্ষমতা ছেড়ে এই অঞ্চল ত্যাগ করে যায়। পূর্ববাংলার মুসলিম সমাজ এই দেশভাগে খুব আনন্দিত ছিল এই কারণে যে তাঁদের জন্য পৃথক বাসভূমি হচ্ছে। তাই জিন্নাহ’র নেতৃত্বে মুসলিম  লীগকে সমর্থন দিতে এই অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে কোন দ্বিধা কাজ করেনি। তবে ১৯৪৭ সালেই ডিসেম্বর মাসের দিকে পাকিস্তানি শাসকবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সেই সময়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ববাংলার কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে এরপূর্বে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ‘ তমদ্দুন মজলিশ ‘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন যার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাবি’ র পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম। এই সংগঠন বাঙালিদের ভাষা , সংস্কৃতি ও কৃষ্টি রক্ষা করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল। “তমদ্দুন মজলিশের” উদ্যোগে এর দিন কয়েক পরে অর্থাৎ ১৬ই‌ সেপ্টেম্বরে ” পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ” এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে তিনটি প্রবন্ধ লেখা হয় ঃ আবুল কাশেম , কাজী মোতাহের হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদ। এঁদের মূল দাবি ছিল পূর্ববাংলার জন্য বাংলা ভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম ,সরকারি অফিস ও আদালতের ভাষা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উর্দু হবে সরকারি ভাষা। উর্দু  পূর্ববাংলার জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে পরিগণিত হবে এবং ইংরেজি পাকিস্তানের জন্য তৃতীয় ভাষা ও বাংলার সাথে সরকারি ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এই সংগঠনের সাথে সেই সময়ের বাঙালি প্রথিতযশা সাহিত্যিক রাজনীতিক সকলেই জড়িত ছিলেন।

১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকায় এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় বলে ‘উর্দু,কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ঐ সমাবেশেই জিন্নাহ’র সামনেই একজন ছাত্র প্রতিবাদ করে বলে উঠে ‘নো’। সেইদিন থেকে শুরু হল পূর্ববাংলায় একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। তবে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তমুদ্দন মজলিশের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের নিজের মুখের  ভাষা ,মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। এই আন্দোলনে সামনের কাতারে চলে আসে ছাত্র সমাজ। সাথে ছিল  জনতা। তারা আকস্মিক ও অন্যায্য সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। ছাত্র জনতার মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের মোহ কাটতে শুরু করে। দ্রুত আন্দোলন দানা বেঁধে ঊঠে। ঢাকা শহর হয়ে ওঠে মিছিলের নগরী। পুলিশ আন্দোলন দমন করতে লাঠিচার্জ করে  এবং  টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে মারতে শুরু করে। কখনও কখনও ১৪৪ ধারাও জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল ,সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপরের ইতিহাস আপনারা জানেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে পাঁচজন পাঁচজন করে ছাত্ররা গ্রুপ করে রাস্তায় নেমে আসে। এরপরের ইতিহাস আপনারা জানেন। সেই প্রসঙ্গে যাবো না। যেহেতু ‘ তমদ্দুন মজলিশ’ পাকিস্তান ভূমিষ্ঠ হ‌ওয়ার পর থেকেই এই কাজে নিয়োজিত ছিল ,অথচ কী এক অজানা কারণে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ,তাই একটু পিছনে গেলাম।

‘৫২ এর ২১ এবং ২২ শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ‌ ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি ছোঁড়ায় শহিদদের রক্ত ছুঁয়ে বাঙালিরা শপথ নেয় দাবি আদায় না করে তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। কাজটি খুব সহজ ছিল না। পাকিস্তানি শাসকবর্গের প্রতি বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটায় সারা বছর জুড়ে মিটিং মিছিল চলতেই থাকল। ক্রমবর্ধমান গণ‌আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই হল তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ( ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত হয়) বাংলাভাষা কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৫৩ সাল হতে পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে সারা দেশে একুশের প্রথম প্রহরে আবালবৃদ্ধবনিতা দলবদ্ধভাবে খালি পায়ে ফুল হাতে শহিদ মিনারে যেত শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। মুখে থাকত অমর একুশের সেই কালজয়ী গান  ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি ,আমি কী ভুলিতে পারি !’ পরবর্তীতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের যে কোন আন্দোলনে অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। একুশে ফেব্রুয়ারি একাধারে শোক , শক্তি , সংহতি শহিদদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ছাড়াও বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনুঘটক হিসাবে কাজ করার প্রেরণা হয়ে বাঙালি জাতির মন ও মননে স্থায়ী আসন করে নেয়। এটা শুধু নিছক শোক দিবস পালনে সীমাবদ্ধ থাকে না।

এবারে আসি কীভাবে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেল সেই প্রসঙ্গে।এই সম্মানজনক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কারা ছিলেন কুশীলব ? কাদের নিরলস পরিশ্রমে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য শহীদ হওয়া বীরদের আত্মদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল?

বাঙালি সবসময় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে।মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার আন্দোলনের সময় এই অঞ্চলের জনগণ পাকিস্তানের কৌশল অনুধাবন করতে পারে।তারা বুঝতে পারে জিন্নাহ ব্রিটিশ শাসকদের মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসভূমির প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে পূর্ববাংলার বাঙালিদের সাথে নিয়েছিলেন মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বুঝাতে ।কিন্তু বাঙালি জাতির প্রতি তার কোন সম্মানবোধ ছিল না। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। সেই ধারণা থেকে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়ে ৬ দফা প্রণয়নে  আওয়ামীলীগকে উদ্বুদ্ধ করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে ৬  দফার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে গড়ে তোলা আন্দোলনই পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। যার একচ্ছত্র নেতৃত্বের স্থানে অভিষিক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মদানে,তিন লক্ষাধিক অত্যাচারিত মা বোনের সম্মানের বিনিময়ে এবং এক কোটি মানুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় গ্রহণকারীদের মানবেতর জীবনযাপনের ফল স্বরূপ ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বীর বাঙালি গেরিলা ও সন্মুখ যোদ্ধারা ভারতীয় মিত্রবাহিনির সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

বিভিন্ন কারণে দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন হয়। এরপরেও বাঙালিদের অহংকারের জায়গা ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং ভাষা শহিদদের কথা কীভাবে বিশ্ববাসীদের জানানো যায় এই নিয়ে কিছু বাঙালির মনে বিষয়টি গেঁথে থাকে। এর প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা / রূপকার ছিলেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারবাসী রফিকুল ইসলাম। সেই সময়টায় আওয়ামীলীগ দীর্ঘ ২১ বৎসর পরে (১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর

দীর্ঘ দিন জাতি প্রগতির পথে হাঁটতে পারেনি) দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসে। ধারণা করি বাংলাভাষাকে নিয়ে দেখা তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে এই সময়টাকে হয়তোবা কুশীলবরা উপযুক্ত সময় ভেবেছিলেন। ১৯৯৭ সালে কোন এক সময় রফিকুল ইসলাম তাঁর বন্ধু আবদুস সালাম, হাফিজুর জাহাঙ্গীর এবং দেশি ও বিদেশী অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এই  উপলক্ষে তাঁরা ভ্যাঙ্কুভারে “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শিশু কিশোরদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রচলন,বিলুপ্তপ্রায় ঝুঁকিগ্রস্ত ভাষা বাঁচানো ,আদিবাসীসহ মাল্টিকালচারাল সমাজে ভাষা সংস্কৃতি, জাতিসত্তার ঐতিহ্য নিয়ে এই সংগঠন কাজ করে। প্রতিদিনই কোন না কোন ভাষা পরিচর্যার অভাবে পৃথিবী থেকে ঝরে যায়।তাঁরা  সিদ্ধান্ত নেন যে পৃথিবী থেকে আর কোন ভাষাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না।

এই উদ্দেশ্য নিয়ে রফিকুল ইসলাম বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাথায় রেখে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষার রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্মান জানানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে জাতিসংঘ কর্তৃক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দিবস পালনের কথা বিবেচনা করে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান বরাবরে ৯ই জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে এক পত্র  লেখেন। কিছুদিন পর জাতিসংঘ থেকে রফিকুল ইসলামকে জানানো হয় যে এই জাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ইউনেস্কোর এবং এই ব্যাপারে  ব্যক্তিগত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়,রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে  ভ্যাঙ্কুভারে   রফিকুল ইসলামকে সভাপতি করে দশজন পরিচালক নির্বাচিত করে “ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি” (IMLLWS ) গঠিত হয়। দশজন পরিচালকের মধ্যে দুইজন বাঙালি, দুইজন ব্রিটিশ, দুইজন ভারতীয় ,একজন জার্মান,একজন চাইনিজ এবং দুইজন ফিলিপিনো ছিলেন। কালবিলম্ব না করে তাঁরা  জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী IMLLWS এর পক্ষ থেকে তাঁদের দাবিটি পেশ করেন। উল্লেখ্য যে পরিচালকরা তাঁদের নিজেদের ভাষায় (সাতটি ) উক্ত পত্রে স্বাক্ষর করেন।

সৌভাগ্যবশত  ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর পূর্নাঙ্গ সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে ইউনেস্কো থেকে জানানো হয় এই ধরণের প্রস্তাব পেশ করতে হবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা নয়। এটি আসতে হবে ইউনেস্কোর নির্ধারিত সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। বিষয়টি জানতে পেরে তখন রফিকুল ইসলাম এবং তাঁর বন্ধুরা বাংলাদেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তবে কাজটি খুব সহজ ছিল না। অনেক দৌড়ঝাঁপ, নিরলস চেষ্টা এবং সহযোগী সকলের বিভিন্ন যোগসূত্রের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে সক্ষম হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়ে সফরে থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে গর্ববোধ করেন এবং এর পিছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব এইচ কে সাদেককে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তখন ইউনেস্কোর  দ্বিবার্ষিক বোর্ড মিটিং এ প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য অল্প সময়ই বাকি ছিল।

এদিকে রফিকুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোদ্ধারা চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলেন। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁদের কাছে ছিল অতি মূল্যবান। কেননা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রস্তাবটি পেশ করতে না পারলে পরের অধিবেশন বসবে দুই বৎসরের পরে। তবে বাঙালির সৌভাগ্য সকল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পাশ কাটিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এবং উদ্যোগে  ফাইল অনুমোদন করে রাষ্ট্রীয় প্রস্তাবটি একেবারে শেষমুহুর্তে ৯ই  সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে ফ্যাক্স যোগে ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে সময়ের স্বল্পতার কারণে নিয়মানুযায়ী হার্ড কপির পরিবর্তে ফ্যাক্সে পাঠানো রাষ্ট্রীয় প্রস্তাবটি ইউনেস্কো অনুগ্রহ করে গ্রহণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এর সাথে আর একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটেছিল। যে পাকিস্তান সরকার বাঙালির প্রাণের দাবীকে বুলেট দিয়ে রুখে দিতে গিয়ে ঢাকার রাজপথ শহীদদের রক্তে ভিজিয়েছিল, ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের প্রস্তাবের সহ উপস্থাপক হয়েছিল সেই পাকিস্তান ,সৌদিআরব , কানাডা ,  ভারত,ইরান,রাশিয়া সহ ২১ টি দেশের সাথে। ভাগ্যের কি পরিহাস!

সকল প্রচেষ্টা,দৌড়াদৌড়ি,অধীর প্রতীক্ষা শেষে ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বরে প্যারিসে ইউনেস্কোর “৩০তম পূর্ণাঙ্গ সাধারণ অধিবেশনে “ ১৮৮টি সদস্য দেশের সর্বসন্মত সিদ্ধান্তে অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন দেশের সীমানা পেরিয়ে বাঙালির রক্তে ভেজা ঐতিহাসিক “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি “ স্বীকৃতি পেল “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে। সেদিন‌ রফিকুল ইসলাম ,আবদুস সালাম , হাফিজুর জাহাঙ্গীরসহ যাঁরা বুকের রক্তে অর্জিত বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাভাষাকে স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্বীকৃতি আদায়ের‌ কাজে অগ্রসৈনিক ছিলেন , গর্বে তাঁদের বুক ফুলে উঠেছিল। চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। মুখে ছিল ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” কেউ বা গুণগুণ করে গাইছিলেন ” আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।” মুক্তিযুদ্ধে শক্তিশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে দেশ জয়ের পর এটি ছিল যেন বাঙালির বিশ্বজয়। অমর একুশের সাথে পরিচিত হল সারা বিশ্ব । সেইসাথে  দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি পেল বাংলাদেশ এবং শান্তি পেল ’৫২ ভাষা আন্দোলনের শহিদদের বিদেহী আত্মা।সেই থেকে আমাদের প্রিয় শহিদ দিবস হয়ে গেল “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। প্রথমবারের মত ২০০০ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হল বিশ্বজুড়ে।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব এইচ কে সাদেক সাহেবের সফল তৎপরতা এই ব্যাপারে বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। ফ্রান্সে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জনাব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, টনি হক , বাংলাদেশ কমিশন ফর ইউনেস্কোর সচিব কফিলউদ্দিন আহমেদ এব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছিলেন দেখেই বোধ হয় ‘বাঙালির ভাষা ‘ তথা বিশ্বের ‘সকল মাতৃভাষার ‘এই অমূল্য স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে’  স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টায় “অংকুরস্থান ভ্যাঙ্কুভার “এ জন্ম নেয়া   “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি “ সংগঠনকে  বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় “একুশে পদক “ এবং রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান“স্বাধীনতা পুরষ্কারে” ভূষিত করেছে।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠার পিছনের কাহিনি সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানার সৌভাগ্য হয় এর অন্যতম কুশীলব হাফিজুর জাহাঙ্গীর প্রদীপ কুমার দত্ত এর কৈশোর –যৌবন সময়ের বন্ধু এবং আমাদের এক আত্মীয় সিডনী প্রবাসী বিলাস ধরের বন্ধু

আব্দুস সালামের কারণে।

আজকের দিনে একুশে ফেব্রুয়ারি আর শোক প্রকাশের দিন নয় । এখন একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জন্য গর্ব করার দিন। সেদিন পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতাসহ সর্বস্তরের বাঙালিরা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে জীবন বিসর্জন দেয়ায় আজ ’৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পরিচিতি পেয়ে হয়ে উঠল অত্যন্ত অহংকারের একটি দিন সারা বিশ্ববাসীর জন্য ।

*** এটি আমার পর্যবেক্ষণ : এই যাবতকাল অর্থাৎ ‘৭৫ এর ১৫ ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নৃশংশ হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে যত অর্জন সব আওয়ামিলীগ সরকারের সময়ে । ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তি , ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতিলাভ , বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার কার্যকর করা , মানবতাবিরোধী হোতাদের বিচারকাজ সম্পন্নকরণ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপন এই সরকারের আমলেই হয়েছে। স্রষ্টা হয়ত তাই চেয়েছিলেন।

*** পোস্টটি অনেক বড় হয়ে গেছে । ধৈর্য ধরে পড়লে বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস অনেকের মনের মুকুরে ভেসে উঠবে। আর আর যারা জানতেন না তারা জানতে পারলেন। সময় নেয়ার জন্য দুঃখিত।

বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *