নেটফ্লিক্স-বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় মুভি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম
কয়েক দশক আগেও মানুষ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেত। ব্যয়বহুল হওয়ায় সবার পক্ষে দেখা সম্ভব হতো না। এরপর টেলিভিশন ও সিডি-ডিভিডি প্লেয়ারের কল্যাণে মানুষ ধীরে ধীরে ঘরে বসেই চলচ্চিত্র দেখা শুরু করে। তবে টেলিভিশন কেনা ও তার ব্যয় বহন করাটাও সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিভ্রাট, সিনেমার মাঝে বিজ্ঞাপনের উপদ্রব এসব সমস্যা তো ছিলই। কাজেই তখনও পর্যন্ত অনেকেই প্রকৃত প্রিমিয়াম এন্টারটেইনমেন্টের স্বাদ পায়নি।
তবে স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে বিনোদন জগতে রাজত্ব করতে শুরু করে ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্মগুলো। OTT এর পূর্ণরূপ হলো Over the top. সহজ ভাষায় স্যাটেলাইট বা ডিশ কানেকশন ছাড়াই মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে সিনেমা দেখার প্ল্যাটফর্মগুলোকে বলে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এগুলো সাধারণত বিভিন্ন অ্যাপ, যেখানে সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইচ্ছামতো সিনেমা দেখা যায়। যেকোনো জায়গায় বসে স্মার্টফোনের মাধ্যমে সিনেমা দেখার সবচেয়ে ভালো এক্সপেরিয়েন্স দেয় এই অ্যাপগুলো। বর্তমান পৃথিবীতে এ ধরনের অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে বর্তমানে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান রাজত্ব করছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো নেটফ্লিক্স।
নেটফ্লিক্স পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাপগুলোর একটি। নিজের পছন্দ অনুযায়ী সেখানে থাকা অসংখ্য সিনেমা, সিরিজ ও ডকুমেন্টারিসহ নানা ধরনের কন্টেন্ট স্বাচ্ছদে উপভোগ করতে পারেন ব্যবহারকারীরা। সেবার মান ও আকর্ষণীয় ইন্টারফেসের সাহায্যে সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে এই প্ল্যাটফর্মটি। বর্তমানে পুরো পৃথিবীর প্রায় ১৫% ইন্টারনেট ট্র্যাফিক জেনারেট হয় শুধুমাত্র নেটফ্লিক্সের মাধ্যমে।
নেটফ্লিক্সের যাত্রা ও ইতিহাস-
১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার দুজন অধিবাসী- মার্ক র্যান্ডলফ ও রিড হ্যাস্টিংস নেটফ্লিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এর নাম ছিল কিবল(Kibble). পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে নাম বদলে রাখা হয় নেটফ্লিক্স(Netflix). নেটফ্লিক্স ছিল মূলত একটি ডিভিডি রেন্টাল সার্ভিস। কারণ আজকের দিনের মতো তখনও স্মার্টফোনের যুগ শুরু হয়নি। তবে ইন্টারনেট তখনও ছিল এবং পার্সোনাল কম্পিউটারে মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত। গ্রাহকরা মেইলের মাধ্যমে ডিভিডি অর্ডার করত এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের কাছে তা ডেলিভার করা হতো।
নেটফ্লিক্সের প্রতিষ্ঠাতারা সাবস্ক্রিপশন বেইজড এন্টারটেইনমেন্টের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা একটি সাবস্ক্রিপশন বেইজড বিজনেস মডেল দাঁড় করান। গ্রাহকরা তাদের ওয়েবসাইটে সাবস্ক্রাইব করার মাধ্যমে ডিভিডি বেছে নেওয়ার অপশন পেত। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আলাদা আলাদা সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান ও পেমেন্ট নির্ধারিত থাকত এবং সাবস্ক্রাইবারদের ঘরে পৌছে যেত তাদের পছন্দ করা মুভির ডিভিডি।
২০০০ সালে নেটফ্লিক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিড হ্যাস্টিংস তৎকালীন এন্টারটেইনমেন্ট দুনিয়ার জায়ান্ট ব্লকবাস্টারের কাছে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নেটফ্লিক্সকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। নেটফ্লিক্সের মার্কেট শেয়ার বিবেচনায় তা অনেক ভালো অফার ছিল। তবে ব্লকবাস্টারের সিইও তার প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দেন। এরপর থেকে নিজ গতিতেই চলতে থাকে নেটফ্লিক্স। পরবর্তী কয়েক বছরে তাদের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়। ২০০১ সালের মধ্যেই এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অর্জন করে ফেলে নেটফ্লিক্স।
২০০৬ সালে নেটফ্লিক্স ১ মিলিয়ন ডলারের একটি কন্টেস্ট লঞ্চ করে। ততদিনে তাদের সাবস্ক্রাইবার ছাড়িয়ে গিয়েছিল ৬ মিলিয়ন। কন্টেস্টের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সিস্টেমকে আরো ইম্প্রুভ করার জন্য আইডিয়া জেনারেট করা। BellKor’s Pragmatic Chaos নামের একটি টিম এই পুরষ্কার জিতে নেয়। তারা এমন কিছু আইডিয়া নিয়ে আসে যা নেটফ্লিক্সের ভবিষ্যৎ সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
২০০৭ সালের পর থেকে নিজেদের একটি স্ট্রিমিং সার্ভিস হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে এগুতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তারা ক্লাউড বেজড ডেটাবেস তৈরির লক্ষ্যে নিজেদের ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল্ডআপ করতে থাকে। নেটফ্লিক্স হয়ে উঠে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং ইউজাররা আনলিমিটেড ভিডিও ওয়াচিং এক্সেস পায়। ডিভিডি প্রোভাইডার থেকে নেটফ্লিক্স পরিণত হয় অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসে। ২০১১ সাল থেকে তারা নিজেদের প্রোডাকশনে স্বতন্ত্র কন্টেন্ট লঞ্চ করা শুরু করে। ২০১৫ তে তারা বিশ্বের প্রায় ৫০ টি দেশে নিজেদের সার্ভিস ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং ২০১৭ সালে ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা ২২০ মিলিয়নেরও অধিক। গুগল প্লে স্টোরে নেটফ্লিক্স ডাউনলোডের পরিমাণ এক বিলিয়নেরও বেশি। সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা আরো বেশি হতো যদি না তারা ২০২০-২২ এ চলমান মহামারী, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদির কারণে কিছুসংখ্যক সাবস্ক্রাইবার হারাতো। তবে এত গ্রাহক হারানোর পরেও নেটফ্লিক্স বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম বড় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম।
ফিচার ও কন্টেন্ট-
কন্টেন্ট লাইব্রেরি-
নেটফ্লিক্সের কন্টেন্টের পরিসর অত্যন্ত বৃহৎ৷ তাদের লাইব্রেরিতে পৃথিবীর অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র, সিরিজ, ডকুমেন্টারি ও ড্রামা সিরিয়ালগুলোর বিশাল কালেকশন রয়েছে৷ প্রতিনিয়ত অসংখ্য নতুন কন্টেন্ট নির্মিত হচ্ছে শুধুমাত্র এর ইউজারদের টার্গেট করে। নেটফ্লিক্স কোনো সেন্সরড প্ল্যাটফর্ম নয়। এর অর্থ হলো এখানে এডাল্ট কন্টেন্ট ও R-Rated কন্টেন্টেরও দেখা মিলবে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা কিছু সিনেমা ও সিরিজ আপনাকে অফার করবে নেটফ্লিক্স। নেটফ্লিক্স পৃথিবীর একমাত্র প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ৭৫০০+ সাব ক্যাটাগরির দেখা মেলে। অর্থাৎ একজন ইউজারের কাছে চয়েজ ও অপশনের কোনো অভাব নেই নেটফ্লিক্সে।
মূল ফিচারসমূহ-
নেটফ্লিক্স ইউটিউবের মতো ফ্রি প্ল্যাটফর্ম নয়। এর সেবা উপভোগ করতে হলে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে ইউজার প্রোফাইল তৈরি করতে হয়। মুভি দেখার জন্য নির্দিষ্ট সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান কিনতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পেমেন্ট মেথড ব্যবহার করা যায়৷ নেটফ্লিক্সের মাসিক সাবস্ক্রিপশন শুরু হয় 7$ এর বেসিক প্ল্যান থেকে। এটি নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল প্যাকেজ। তবে এই প্যাকেজে আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানো হবে৷ অ্যাড ফ্রি এক্সপেরিয়েন্স পেতে চাইলে নেটফ্লিক্স চার্জ করে মাসিক দশ ডলার। এছাড়া 15$ এর স্ট্যান্ডার্ড প্যাক ও 20 $ এর প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশনও অফার করে নেটফ্লিক্স।
নেটফ্লিক্সের অন্যতম একটি দারুণ ফিচার হলো স্ক্রিন শেয়ারিং। এর মাধ্যমে একই সাথে একাধিক ডিভাইসে লগ ইন করে একের অধিক ব্যক্তি একই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারবেন। এবং একইসাথে ভিডিও দেখতে পারবেন। 7$ ও 10$ প্যাকে এই সুবিধা নেই। স্ট্যান্ডার্ড ও প্রিমিয়াম ইউজাররাই কেবল এটি উপভোগ করতে পারবেন। স্ট্যান্ডার্ড ইউজাররা সর্বোচ্চ ২ টি ও প্রিমিয়াম ইউজাররা ৪ টি ডিভাইসে স্ক্রিন শেয়ার করতে পারেন৷ এছাড়া প্রিমিয়াম ইউজার বাদে বাকি ইউজাররা আলট্রা এইচডি কোয়ালিটিতে মুভি দেখার সুবিধা পাবেন না। পাশাপাশি বেসিক প্যাক(7$) ছাড়া বাকি সকল সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানেই ডাউনলোড অপশন পাওয়া যায়।
ইন্টারফেস এক্সপেরিয়েন্স ও অন্যান্য ফিচার-
নেটফ্লিক্স তার ইউজারদের দেয় সর্বোত্তম কোয়ালিটির ভিডিও দেখার এক্সপেরিয়েন্স। অডিও কোয়ালিটিও অন্যান্য ফ্রি প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে অনেক ভালো ও প্রিমিয়াম। এছাড়া প্রতিটি কন্টেন্টের সাথে সাবটাইটেল দেখার সুবিধা রয়েছে। আছে ইউজারদের প্রিয় কন্টেন্টগুলোকে প্লেলিস্ট আকারে সেইভ করে রাখার সুবিধা। নেটফ্লিক্স আপনার পছন্দের দিকটি খেয়াল রেখে অ্যাক্টিভিটি মনিটর করে আপনার উপযোগী কন্টেন্টগুলোকে রেকমেন্ড করবে৷ দেখার পর কন্টেন্টগুলোকে ভালো লাগার উপর ভিত্তি করে রেটিং দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ফোন ব্যতীত অন্যান্য ডিভাইস যেমন স্মার্ট টিভিতে নেটফ্লিক্স উপভোগ করা যায়। এমনকি গেমিং কনসোলের সাহায্যেও নেটফ্লিক্স প্লে করা যায়।
নেটফ্লিক্সে রয়েছে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের মতো উপকারী ফিচার৷ কোনো বাবা-মা চাইলে সন্তানের উপযোগী কন্টেন্ট তার জন্য নির্ধারিত করে দিতে পারবেন। নেটফ্লিক্সে অনেক এডাল্ট কন্টেন্ট রয়েছে যেগুলো ছোট বাচ্চাদের সামনে আসা উচিত না। এগুলো তাদের থেকে দূরে রাখতে চাইলে প্রোফাইলে গিয়ে Allowed TV shows and Movies অপশন থেকে Little Kids সিলেক্ট করে দেওয়া যায়। এছাড়া সন্তান প্রাইভেসি যাতে চেঞ্জ করতে না পারে তার জন্য রয়েছে পিন কোডের মাধ্যমে প্রোফাইল লক করে রাখার ব্যবস্থা।
এছাড়া, নেটফ্লিক্সের ডিভিডি প্রোভাইডিং সার্ভিসটি এখনও বন্ধ হয়নি। তবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু দেশের নাগরিকরা এখনও এই সেবা পেতে পারেন।
অসুবিধাসমূহ-
নেটফ্লিক্স তার ইউজারদের সর্বোত্তম এক্সপেরিয়েন্স দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছু সমস্যা রয়েই যায়৷ নেটফ্লিক্সকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ হয় যে বিষয়ে, তা হলো কন্টেন্টের প্রাচুর্যতা। নেটফ্লিক্সের অরিজিনাল শোগুলো ছাড়া বাইরের কন্টেন্ট রিলিজ হয় অনেক দেরিতে। ফলে নতুন কোনো হাইপ তোলা মুভি দ্রুত দেখতে সিনেমাপ্রেমীরা ধাবিত হন পাইরেটেড সাইটের দিকে। এছাডা ইন্টারনেট সংযোগ কিছুটা দুর্বল হলে নেটফ্লিক্সে ভালো এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া যায় না।
পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও নেটফ্লিক্স সবার উপযোগী নয়। কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় যে কারো পক্ষে তা উপভোগ করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু নেটফ্লিক্সে কোনো ফ্রি ট্রায়ালেরও ব্যবস্থা নেই। তাই কেউ চাইলে যাচাই করেও দেখতে পারে না। এটি নেটফ্লিক্স নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনাগুলোর একটি।
নেটফ্লিক্স কন্টেন্টগুলো অধিকাংশ সময়েই বিভিন্ন পাইরেটেড মুভি সাইটে পাবলিশ হয়ে যায়। যদিও এটা নেটফ্লিক্সের নিজের কোনো সমস্যা নয়, তবে নেটফ্লিক্সের জন্য ক্ষতির অন্যতম বড় কারণ এটি। টাকা খরচ করে বৈধ উপায়ে দেখার চাইতে মানুষ বিনা খরচের পথকেই বেশি বেছে নেয়।
শেষ কথা-
ছোটখাট কিছু অসুবিধার কথা বাদ দিলে নেটফ্লিক্স বিনোদন জগতের অন্যতম সেরা স্ট্রিমিং সার্ভিস। প্রচুর ইউনিক কন্টেন্ট ও ইউজার ফ্রেন্ডলি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে নেটফ্লিক্স সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে। নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সুযোগ করে দিয়েছে প্রিমিয়াম এক্সপেরিয়েন্সে ঘরে বসে সিনেমা উপভোগ করার। আমাদেরও উচিত অনৈতিক উপায়ে পাইরেটেড কন্টেন্ট ব্যবহার কমিয়ে এই ধরনের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু করা।