Islamic
1 min read

যাকাত কি বা কাকে বলে? যাকাতের শর্তসমূহ ও যাকাত বন্টনের খাত

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হলো যাকাত। পবিত্র কুরআনের যেখানেই নামাজের কথা বলা হয়েছে, সেখানেই পর পর যাকাতের কথা বলা হয়েছে। তাই যাকাতের গুরুত্ব যে কত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কুরআনে বলা হয়েছে, “অর্থাৎ, তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর।” নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

যাকাত কি বা কাকে বলে?

যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো –

  • বৃদ্ধি পাওয়া
  • পবিত্র করা
  • চমুৎকার গুণকীর্তন
  • পরিশুদ্ধ
  • প্রাচুর্য
  • প্রশংসা ইত্যাদি।

পারিভাষিক অর্থে

ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মতে, “যাকাত তাকে বলা হয়ে থাকে যা প্রদান করলে মন বা আত্মা পবিত্রতা লাভ করে, এবং সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে এবং সম্পদ পরিচ্ছন্ন হয়।”

ইমাম নববী (র.) বলেন, “ধন সম্পদ হতে একটি নির্দিষ্ট অংশ বের করাকে যাকাত বলে। আর যে সম্পদ থেকে যাকাত বের করা হয় তা জাকাত আদায়ের কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রকৃত পক্ষে তার মধ্যে বরকত হয় এবং তা বিপদাপদ হতেও রক্ষা পায়।”

ইমাম আইনীর মতে, “যাকাত প্রকৃতপক্ষে নিসাবের একটি নির্ধারিত অংশ, যা বছরান্তে গরিবদুঃখীদের দান করা হয়ে গেছে।”

কারো কারো মতে, “শরীয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট সম্পদ হাশেমী ও তাদের মাওলা ব্যতীত গরিব অনাথ মুসলমানকে স্বত্বাধিকারী করা। কোন উপকারের আশা করা ব্যতীত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”

শরিয়তের পরিভাষায়, সাধারণত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা এর সমপরিমাণ অর্থ সম্পদ থাকলে তা থেকে বার্ষিক আয়ের ২.৫% অংশ আল্লাহর পথে দান করে দেওয়ার নাম যাকাত। এতে সম্পদ হালাল ও পবিত্র হয়।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি যাকাত দিল তার থেকে যেন শয়তান নির্মূল হয়ে গেল।”

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ :

১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা,কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।

২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরজ নয়।

৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ নয়।

৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরজ নয়।

৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরজ নয়।

৬. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরজ হয় না।

৭. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।

৮. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।

৯. মাল বর্ধনশীল হওয়া। যাকাতের ফজিলত, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দান করবেন। আর তিনিই উত্তম রিজিকদাতা। (সুরা সাবা,আয়াত:৩৯)

যাকাত ব্যয়/ বন্টনের খাত কয়টি ও কি কি?

কুরআনের সূরা আত-তওবার ৬০ নাম্বার আয়াতে যাকাত বন্টনের ৮ টি খাত আল্লাহ তা’আলা নির্ধারণ করেছেন। এগুলো হলো –

  • ফকির (হানাফী ইমামদের মতে, ফকির সে ব্যাক্তি যার নিকট যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই অর্থাৎ যৎসামান্য সম্পদ রয়েছে।)
  • মিসকীন (হানাফীদের মতে, যার সামান্য পরিমাণ সম্পদও নেই। এমনকি বাড়ি ঘরও নেই – সেই মিসকিন।
  • যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী (ইমাম রাষ্ট্রের কর্মচারী অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের যাকাত আদায়কারী কর্মচারীগণও জাকাতের অর্থের হকদার)
  • নও মুসলিম (তথা ইসলামের প্রতি কারো অন্তরকে আকৃষ্ট করার জন্য কাউকে যাকাতের অর্থ দান করা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন কাউকে জাকাতের সম্পদ দেওয়া যায়, যাকে দিলে তার মন ইসলাম গ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট থাকবে অথবা নও মুসলিম যাকে দিলে তার মন ইসলামের প্রতি দৃঢ় থাকবে অথবা অমুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকায় কোন অমুসলিম নেতাকে ইসলামের প্রতি মিতালি এবং ঐ এলাকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য তাকে যাকাত দেওয়া যেতে পারে।)
  • ক্রীতদাস (ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীদের মুক্ত করে দেওয়ার জন্যে তাদেরকে মুক্তিপণ হিসেবে জাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।)
  • ধনী সম্পদশালী ব্যক্তি যার সম্পদের তুলনায় ঋণ বেশি। ( যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত। স্বীয় সঞ্চিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ঋণ করে তার পরিবার পরিচালনা বা ব্যবসা-বাণিজ্য করলে এবং সে ঋণ পরিশোধে অক্ষম গরিব ঋণগ্রস্তকে জাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে।)
  • আল্লাহর পথে জেহাদরত ব্যক্তি ( আল্লাহর পথে তথা জিহাদ পরিচালনা বা আল্লাহর দিন প্রতিষ্ঠাকামী মুজাহিদদের জিহাদ ও আন্দোলন পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য জাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে।)
  • মুসাফির (যিনি ভ্রমণকালে অভাবে পতিত অর্থাৎ মুসাফির অবস্থায় থাকাকালীন যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে, চলার মতো কোন অবস্থা নেই, তাকে জাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে।)

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

অর্থঃ “যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আত তওবা – ৬০)

যেসব খাতে জাকাত ব্যয় করা যাবে না

  • ধনী স্বচ্ছল বা অর্থ সম্পদশালী লোক
  • কর্মক্ষম , উপার্জনশীল ও শক্তি সম্পন্ন মানুষ
  • খোদাদ্রোহী, নাস্তি, ইসলামের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এমন লোক কিংবা প্রতিবন্ধকতাকারী। সর্বসম্মত মতামতে এদেরকে জাকাত দেওয়া জায়েজ নেই। জমহুরে ফকীহদের মতে এতে জিম্মারাও জাকাত পেতে পারে না।
  • যাকাত দাতার সন্তান, পিতামাতা এবং তার স্ত্রীর এরাও পাবে না। আর অন্যান্য নিকটাত্মীয় পাবে যদিও এ সম্পর্কে ইমামদের মতভেদ রয়েছে।
  • নবী করীম (সাঃ) এর পরিবার এবং বংশধরও পাবে না। বনী হাশেম ও বনু মুত্তালিবের লোকদের ব্যাপারে ইমামদের মতভেদ রয়েছে। এমনকি বনূ হাশেমের মাওলাগণও জাকাত পাবে না ।

যাকাত সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ও হাদিস

পবিত্র আল কুরআনে যাকাত সম্পর্কে মোট ৩২টি আয়াত আছে। নিম্নে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা হলো-

সূরা হাজ্জে বলা হয়েছে, “আমি যদি তাদেরকে পৃথিবীতে রাজত্ব দান করি, তাহলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখবে, আর সব কাজের চূড়ান্ত পরিণতি একান্তই আল্লাহর ইচ্ছাধীন।” (সূরা হাজ্জ – ৪১)

সূরা বাকারায় জাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে – “এটা (যাকাত) প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকায় জীবীকার জন্যে জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারো নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে।তোমরা তাদের (দারিদ্র্যের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা সবশেষ অবহিত।” (সূরাহ বাকারা -২৭৩)

সূরা নূরে বলা হয়েছে – “সে সব লোক, যাদেরকে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ, সলাত কায়িম এবং যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।” (সূরা নূর -৩৭)

সূরা আনআমে বলা হয়েছে, এবং তিনিই মাচাযু্ক্ত (কাণ্ডবিহীন) ও মাচাবিহীন (কাণ্ডবিশিষ্ট) বৃক্ষ-লতা সম্বলিত বাগানসমূহ, খেজুর গাছ, বিভিন্ন স্বাদের খাদ্য শস্য, যায়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন- যেগুলো পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন। যখন তা ফলবান হয় তখন তোমরা তার ফল খাও এবং ফল সংগ্রহের দিনে তার হাক্ক (অর্থাৎ উশর) প্রদান কর এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না। (সূরা আনআম – ১৪১)

এ সর্ম্পকে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন অর্থ্যাৎ “এবং তোমরা আল্লাাহ তা’লার সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায় করো। অত:পর তিনি তা দ্বীগুন করে দেবেন।”(সুরা আর রুম – ৩৯)

হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে : আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন.রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরন করেন তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন। (বুখারী)। অন্য হাদীসে এসেছে: জাবীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল সাঃ বলেছেন যখন তোমাদের নিকট যাকাত আদায়কারী আসবে তখন সে যেন তোমাদের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যায়।” (মুসলিম)

হযরত আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে ধন-সম্পদ পেয়েছে কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন ওই ধন-সম্পদ এমন বিষধর সাপে পরিণত হবে যার মাথার ওপর থাকবে দুটি কালো দাগ। এ সাপ সে ব্যক্তির গলায় পেচিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দুগালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে, আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ। (সহীহ্ বুখারী: ১৪০৩)

হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “যখন তোমাদের কাছে জাকাত আদায়কারী আসবে সে যেন তোমাদের নিকট হতে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়। ” (মুসলিম)

এক বর্ণনায় আছে কোন ব্যাক্তি রাসূল (সাঃ) এর কাছে নিজের জাকাত নিয়ে আসত, তখন রাসূল (সাঃ) বলতেন, “আল্লাহ তুমি তার প্রতি রহমত বর্ষণ কর।”

এছাড়াও যাকাত নিয়ে আরও অনেক কুরআনের আয়াত ও হাদিস রয়েছে।

যে যে মালে যাকাত দিতে হয়

টাকা পয়সা, সোনা-রূপা, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, জমিনে উৎপাদিত ফসল, মাটির নিচে প্রাপ্ত গুপ্তধন, খনিজ দ্রব্য, ব্যাংকে জমানো টাকা, শেয়ার বন্ড ইত্যাদি সহ এককথায় মুসলমানদের প্রায় সব মালেই জাকাত দিতে হয়।

যাকাতের হিসাব / ক্যালকুলেটর করার নিয়ম / পরিমাণ

১. গবাদি পশুঃ ছাগল, ভেড়া, উট, ঘোড়া যদি মালিকের শ্রম ব্যতিরেকে চারণভূমিতে বছরের অধিক সময় বিচরণ করে প্রতিপালিত হয়। অর্থাৎ নিজের ঘাস, পানি নিজেই সংগ্রহ করে, যেমন – চর অঞ্চলে এরূপ দেখা যায় এবং গৃহস্থালি কাজের অতিরিক্ত, যা বিক্রির জন্য বা দুধ বা বৃদ্ধির জন্য রাখা হয়, এমন পশুর জাকাত দেওয়া ওয়াজিব।

২. সোনা রূপার জাকাতঃ স্বর্ণ বিশ মিসকাল বা সাড়ে সাত তোলা হলে এবং রূপা দুইশত দিরহাম বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা হলে এর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে।

৩. ভূমির উৎপাদনঃ ধান, গম, জব, খেজুর, আঙ্গুর, শস্য ও ফলমূল যা সেচ ব্যতীত, বৃষ্টি বা নদীর পানি দ্বারা উৎপাদিত হয়, এতে উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হয়। ফসল কম বেশি যাই হোক না কেন, এক দশমাংশ হারে দিতে হবে। তবে এসব ফসল যদি সেচের পানি দ্বারা উৎপন্ন হয় তাহলে বিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে।

৪. জমিনে গচ্ছিত গুপ্তধনঃ শরিয়তের পরিভাষায় একে কানয বলা হয়। আর খনিজ ধাতব দ্রব্য যেমন – সোনা, রূপা, তামা ইত্যাদিকেও মা’আদিন বলা হয়। আর উভয় দ্রব্য দুটিকে একসাথে রেকায বলা হয়। যেকোনো অবস্থায়ও কানযেরও এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে। একে খুমুসও বলা হয়।

৫. ব্যবসায়ী মালঃ ব্যবসায়ে নিয়োজিত সম্পদ, পণ্যদ্রব্য, যন্ত্রপাতি, কাপড়, খাদ্য, সাজ-সরঞ্জাম, অলঙ্কার, মূল্যবান পাথর, পশু, গাছপালা, জমি, শিল্প-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থাবর অস্থাবর সম্পদে নিসাব পরিমাণ হলে এবং বছর পূর্ণ হলে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে।

৬. যেসব জিনিসে তৈজসপত্র ব্যবহার করা হারাম, তা স্বর্গ, রৌপ্য ইত্যাদি মূল্যবান ধাতব দ্রব্য দ্বারা তৈরি করা হলে তাতে এবং স্বর্ণে রোপ্যে নির্মিত উপঢৌকনাদিতে ওজনে বা মূল্যের নিসাব পরিমাণ হলে তাতে জাকাত দেওয়া ওয়াজিব।

৭. স্বাধীন শ্রম ও পেশাভিত্তিক উপার্জিত, অর্জিত সম্পদের উপর জাকাত দিতে হবে। তবে এর জন্য বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং মাল পাওয়ার সাথে সাথেই যাকাত দিতে হবে।

৮. শেয়ার বন্ড,সিকিউরিটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি অর্থের মূল্যবান বহন করে তাতেও জাকাত দিতে হবে।

অগ্রিম যাকাত আদায় করা বৈধ কিনা?

অগ্রিম যাকাত আদায় করা বৈধ কিনা অর্থাৎ জাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে জাকাত আদায় করা জায়েজ কিনা? এ নিয়ে বিভিন্ন ইমামগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। নিম্নে এ নিয়ে আলোচনা করা হলো –

১. ইমাম মালিক (র.) ও লাইস (র.) এর অভিমতঃ ইমাম মালিক (র.) ও লাইস (র.) এর মতে, সময়ের পূর্বেই অগ্রিম জাকাত আদায় করা মাকরূহ।

২. হজরত হাসান বসরী (র.) এর অভিমতঃ হজরত হাসান বসরী (র.) এর মতে, অগ্রিম জাকাত আদায় করা অবৈধ। এরূপ অবস্থায় পুনরায় আদায় করতে হবে।

৩. জমহুরের অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী (র.) ও আহমদ (র.) তথা জমহুরের মতে, অগ্রিম জাকাত আদায় করা বৈধ। তাঁরা প্রমাণ হিসেবে ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিস ও আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হাদিসটি ব্যাখ্যা করেন।

তবে ইমামদের মাঝে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে যে, কত বছরের জাকাত আদায় করা বৈধ। ইমাম শাফেয়ীর, শুধু এক বছরের অগ্রিম জাকাত আদায় করা যেতে পারে। ইমাম আহমদ (র.) বলেন, দু বছর পর্যন্ত অগ্রিম জাকাত আদায় করার সুযোগ রয়েছে ।

যাকাত না দেওয়ার পরিণাম

কি কারণে জাকাত ফরজ হয়েছে তা স্পষ্টভাবে কুরআনে বর্ণিত আছে । জাকাত অস্বীকারকারী কাফের। তার বিরুদ্ধে লড়াই করা আবশ্যক। জাকাত না দেওয়ার পরিমাণ সম্পর্কে সূরা তওবার ৩৪-৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

অর্থঃ “হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।” (সূরা তওবা – ৩৪)

يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَـٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ

অর্থঃ “সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।”

অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে কিছু সম্পদ দান করেছেন, আর তারা তা নিয়ে কৃপণতা করে তারা যেন মনে করে না যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল, বরং এটা তাদের পক্ষে অমঙ্গল। অচিরেই কিয়ামতের দিন তাই তাদের ঘাড়ে শিকলের ন্যায় পরিয়ে দেওয়া হবে, যার ব্যাপারে তারা কৃপণতা করছে।

এ নিয়ে কয়েকটি হাদিস হলো –

হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “যাকে আল্লাহ তা’আলা সম্পদ দান করেছেন আর সে তার জাকাত প্রদান করে নি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা সাপ স্বরূপ বানানো হবে যার চোখের উপর দুটি কালো বিন্দু থাকবে। কিয়ামতের দিন তাকে তার গলায় বেড়ী স্বরূপ করা হবে। তারপর সাপ তার মুখের দুদিকে কামড়ে ধরবে। তারপর বলবে আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সংরক্ষিত ধন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ” ওয়ালা ইয়াহসাবান্নাল্লাযীনা ইয়াবখালূনা” আয়াত পাঠ করলেন।” – (বুখারী)

হজরত আবু যর (রাঃ) রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে কোন ব্যাক্তির উট, গরু বা ছাগল, ভেড়া থাকবে অথচ সে তার হক অর্থাৎ জাকাত আদায় করবে না ঐগুলোকে কিয়ামতের দিন পূর্বে যেমন ছিল তার চেয়ে বিরাট ও মোটাতাজা করে আনা হবে তারা তাকে তাদের খুর দ্বারা পিষতে থাকবে এবং শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে যখনই তাদের শেষ দলটি অতিক্রম করতে থাকবে প্রথম দলটিকে তার উপর পুনরায় আনা হবে। এভাবে চলতে থাকবে যে পর্যন্ত মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালা সমাধা না হয়ে যায়।” – (বুখারী ও মুসলিম)

সুতরাং উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, জাকাত না দেওয়ার পরিণাম কতই ভয়াবহ।

যাকাত ফরজ হওয়ার হিকমত বা কারণ

ইসলামী শরীয়ার যেকোনো বিধান প্রবর্তনের পিছনে কোন না কোন হিকমত বা কারণ রয়েছে। তাই যাকাতের মাঝেও নিম্নলিখিত রহস্যগুলো পাওয়া যায় –

  • সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূর করে
  • ধনী ও গরিবের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টির শুভসূচনা হয়
  • অভাবমুক্ত ইসলামী সমাজ গঠিত হয়
  • যাকাত অর্থদান ও ব্যয়ের প্রতি অভ্যস্থ করে
  • যাকাতদাতার সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টি হয়
  • রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হবে
  • জাকাতদাতার আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয়
  • লোভ নিবারন করে
  • জাকাতের মাধ্যমে মালের প্রবৃদ্ধি ঘটে
  • জাকাত ধন-সম্পদের পবিত্রতা বিধান করে
  • জাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে
  • জাকাত দ্বারা আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় হয় ইত্যাদি।

জাকাত প্রদানকারীর জীবনে যাকাতের প্রভাব বা যাকাতের গুরুত্ব

মহান আল্লাহ তা’ আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তাদের মাল-সম্পদ হতে তুমি জাকাত আদায় কর ফলে তুমি এটা দ্বারা তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” এ পবিত্রকরণ ও পরিশুদ্ধকরণ বস্তুগত ও আত্মিক উভয় প্রকার হতে পারে। নিম্নে জাকাত প্রদানকারীর জীবনে যাকাতের প্রভাব বা যাকাতের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো –

  • জাকাত মানুষকে দানে ও ব্যয়ে অভ্যস্থ করে
  • যাকাত মানুষকে লোভ থেকে মুক্ত রাখে
  • আল্লাহর চরিত্রে ভূষিত হয়
  • জাকাত আল্লাহর নিয়ামতের শোকর
  • জাকাত ভালবাসার উদ্ভাবক
  • দুনিয়াপ্রীতির চিকিৎসা
  • ধনীর ব্যক্তিক্ত বিকাশ করে
  • যাকাত ধন-সম্পদের পবিত্রতা বিধান করে
  • জাকাত হারাম মালকে পবিত্র করে না
  • জাকাত মূলধনে বৃদ্ধি করে ইত্যাদি।

সুতরাং বলা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক (নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে) প্রত্যেক মুসলমান নর – নারীর উপর জাকাত আদায় করা ফরজ।

Rate this post