পানির অপর নাম জীবন। এই স্বচ্ছ ও বর্ণহীন পদার্থটি ছাড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যও আমাদের পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের প্রয়োজন নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি। আমাদের ব্যস্ত জীবনে, বিশেষ করে শহুরে জীবনে আমরা বোতলজাত পানি বা জার পানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
প্রতিদিন হোটেল বা রেস্তোরাঁ, অফিস, রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে, উৎসব-অনুষ্ঠান, ভ্রমণপথে, বাসাবাড়িতে এসব উৎপাদিত (বোতলজাত ও জার পানি) খাবার পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা যারা প্রতিনিয়ত এসব বোতলজাত খাবার পানি খেয়ে যাচ্ছি, কখনো কি ভেবেছি এই পানি কতটা নিরাপদ? এসব বোতলজাত খাবার পানি পান করে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছি না তো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ও সাধারণ জনগণকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতন করতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)।
বিএআরসি সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে। বিশেষত শাকসবজিতে কীটনাশক দূষণ, বোতলজাত ও জার পানিতে বিদ্যমান খনিজ উপাদানের মাত্রা ও গুণাগুণ নির্ণয়ে ‘Qualitative Assessment of Bottled Drinking Water and Evaluation of Pesticides Residue at Raw, Washed and Cooked Vegetables’ শীর্ষক প্রকল্পে ৩৫টি ব্র্যান্ডের বোতলজাত ও ২৫০টি জার পানির নমুনা সংগ্রহ করে বিএআরসি। রাজধানী ঢাকা শহরের ২৪টি এলাকা থেকে এ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষায় প্রায় সব জারের পানি দূষিত প্রমাণিত হয়। কয়েকটি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি নিরাপদ পাওয়া যায়।
বিএআরসিএ গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর থেকে বোতল ও জারের পানির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। জার পানির ক্ষেত্রে ঢাকার ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনপুর, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ৩৫টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির নমুনা ও বিদেশি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির মান নির্ণয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তারা এ গবেষণা করেছে।
বিএআরসির প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, এসব বোতলজাত ও জারের পানিতে আছে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন ই-কলি (Escherichia coli)। এই ব্যাকটেরিয়া থেকে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠান্ডা। এ ছাড়া এটি আস্তে আস্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ১০০ মিলি জার পানির নমুনায় ১ থেকে ১৬০০ এমপিএনের বেশি ই-কলি পাওয়া গেছে, যেখানে বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী শূন্য ই-কলি থাকা উচিত।
এ গবেষণায় বিএআরসি ব্র্যান্ড বোতল ও জার পানির বিভিন্ন উপাদানগুলোর পরিমাণগত ও গুণগত মান বিশ্লেষণ করে তার ফল প্রকাশ করেছে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, খাবার পানিতে বিভিন্ন সাধারণ উপাদান যেমন টিডিএস (খনিজ উপাদান, লবণ, মেটাল, আয়ন ইত্যাদি), ক্লোরাইড, কলিফরম, ফ্যেকাল কলিফরম, পিএইচ, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, লিড, ক্রোমিয়াম, আয়রন ইত্যাদি কী পরিমাণে থাকা উচিত এবং ব্র্যান্ড বোতলজাত পানি ও জার পানিতে তা কী পরিমাণে আছে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ব্র্যান্ড বোতলজাত পানি বিডিএস মান অনুসরণ করতে চেষ্টা করলেও তা যথাযথ নয়। বোতলের গায়ে কলিফরম বা ফ্যেকাল কলিফরমের কোনো উল্লেখ থাকে না। অন্যদিকে জার পানি কোনো গুণগত মানই বজায় রাখে না।
ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান জনগণের খাবার পানির চাহিদার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব দূষিত জার পানি ও ব্র্যান্ডবিহীন বোতলজাত পানির ব্যবসা করছে আর সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে বিষাক্ত পানি। যে বিষ মানুষকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে তুলছে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যবসায়ী কীভাবে ব্যবসা করছেন, যেখানে পানি উৎপাদন, বোতলজাত ও বাজারজাত করতে গেলে বিএসটিআই, ওয়াসা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি ও লাইসেন্স নিতে হয়।
বিএআরসি তাদের গবেষণায় সাধারণ মানুষদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছে, সব সময় নিরাপদ পানি যেমন ফুটানো পানি ব্যবহার করতে হবে এবং জার পানি ও বোতলজাত পানি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক নিয়মিত বাজার পরিদর্শন ও পানির গুণগত মান পরীক্ষা করতে হবে এবং অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে।