পদ কী? পদ কয় প্রকার ও কী কী?

যে সব অর্থবােধক শব্দ বাক্যে ব্যবহূত হয়, সেগুলাে প্রত্যেকটিই এক একটি পদ। যেমন- জেলেরা পুকুরে মাছ ধরে। এখানে জেলেরা, পুকুরে, মাছ, ধরে- এ চারটি শব্দ রয়েছে। সুতরাং এ চারটি শব্দের প্রত্যেকটিই এক একটি পদ। অর্থাৎ, বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি অর্থবােধক শব্দকে এক একটি পদ বলে

অথবা আমরা বলতে পারি, যে শব্দ বা ধাতু বিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যে প্রয়োগ করবার উপযোগী হয় তাই পদ ।

আরো বিস্তারিত ভাবে পদ কাকে বলে তা বললে, বাক্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই অপর কোনো বর্ণ বা বর্ণসমষ্টির সাথে যুক্ত হয়ে রূপান্তর লাভ করে পদে। শব্দের সাথে এরূপ বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি যোগ হলে একে বলা হয় বিভক্তি। বিভক্তি যুক্ত শব্দই আসলে পদ।

ভাষায় কেবল শব্দ ও ধাতু ব্যবহৃত হয় না। ভাষায় ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে শব্দ ও ধাতুর সঙ্গে বিভক্তির যোগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কেননা, বাক্যে অর্থাৎ ভাষায় প্রত্যেকটি শব্দ ব্যবহারের একটি নির্দিষ্টস্থান আছে। বাক্যের মধ্যে যেখানে যে শব্দের ব্যবহার আবশ্যক সেখানে সে শব্দের প্রয়োগ না হলে কথার অর্থ বা বাক্যের অর্থ কেউ বুঝতে পারে না। যেমন -মানুষ বাঘ মারে

এই বাক্যটির প্রথম শব্দ মানুষ, দ্বিতীয় শব্দ বাঘ এবং মারে শব্দ তৃতীয় স্থানে অবস্থিত। এর প্রথম দুটি শব্দের স্থান পরিবর্তন করে দিলে বাক্যটি দাঁড়ায়- বাঘ “মানুষ মারে” (Tigers kill man), এতে বক্তার বক্তব্য একেবারেই আলাদা হয়ে যায়।

কাজেই, বাক্যের শব্দ বসানোর স্থান নির্ণয় করার জন্য শব্দের সঙ্গে কতগুলো চিহ্ন বা বিভক্তি (যেমন- শব্দ বিভক্তি, ক্রিয়া বিভক্তি) যোগ করতে হয়। বাক্যে ব্যবহৃত এরকম অবস্থান পরিচায়ক চিহ্নযুক্ত (অর্থাৎ বিভক্তিযুক্ত) শব্দের নাম পদ।

পদের উদাহরণ দাও :-

দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা মানুষের চিরন্তন কল্পনার রাজ্য চাঁদের দেশে পৌঁছেছেন এবং মঙ্গলগ্রহেও যাওয়ার জন্য তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছেন। উপর্যুক্ত বাক্যটিতে ‘রা’ (অভিযাত্রী+রা), ‘এর’ (মানুষ+এর), ‘র’ (কল্পনা+র), ‘এ’ (মঙ্গলগ্রহ+এ) প্রভৃতি চিহ্নগুলোকে বিভক্তি বলা হয়। আর বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি বিভক্তিযুক্ত শব্দ মাত্রই এক একটি পদ।

পদ কয় প্রকার ও কী কী?
পদ মােট পাঁচ প্রকার। যেমন-
ক. বিশেষ্য পদ
খ. সর্বনাম পদ
গ. বিশেষণ পদ
ঘ. অব্যয় পদ
ঙ. ক্রিয়া পদ।

ক. বিশেষ্য পদ : যে পদ দ্বারা কোন কিছুর নাম বুঝায়, তাকে বিশেষ্য পদ বলে। যেমন–
ব্যক্তির নাম : অনিক, মাহিন।
বস্তুর নাম : চেয়ার টেবিল।
প্রাণীর নাম : গরু, ছাগল।
স্থানের নাম : ঢাকা, কুমিল্লা।
জাতির নাম : হিন্দু, মুসলমান।
সমষ্টির নাম : সভা, সমিতি।
গুণের নাম : সততা, ভদ্রতা।
ক্রিয়ার নাম : পড়া, খেলা।

 

বাক্যে প্রয়োগ
মাহিন বই পড়ে।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী।
গরু ঘাস খায়।
মুসলমানেরা সাহসী জাতি।

খ. সর্বনাম পদ : যে পদ বিশেষ্য পদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে। যেমন– আমি, তুমি, সে, যে, যার, তার, কে, কাকে, তারা, তোমরা, এটা ইত্যাদি।

বাক্যে প্রয়োগ
আমি ভাত খাই।
সে স্কুলে যায়।
তিনি একজন সৎ লোক।
তারা ফুটবল খেলে।

সর্বনামের শ্রেণিবিভাগ :-

বাক্যে নানা রূপে সর্বনাম পদের প্রয়োগ হয়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সর্বনাম পদ সমূহকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –

ব্যক্তি বা পুরুষবাচক : তুমি, তোমরা সে, আমি, আমরা, তিনি, তারা, তাঁরা, এ, এরা।

আত্মবাচক : স্বয়ং, নিজে, খোদ, আপনি।

সামীপ্যবাচক : এ, এই, ইহাৱা, ইনি ইত্যাদি।

দূরত্ববাচক: ঐ, ঐসব, সব।

সাকল্যবাচক : সব, সকল, সমুদয়, তাবৎ।

প্রশ্নবাচক : কি, কী, কে, কিসে, কোন, কার, কাহার।

অনির্দিষ্টভাজ্ঞাপক : কেউ, কোন, কিছু, কেহ।

ব্যতিহারিক : আপনা আপনি নিজে নিজে পরস্পর ইত্যাদি।

সংযোগজ্ঞাপক যে, যিনি, যাঁরা, যারা, যাহারা ইত্যাদি।

অন্যাদিবাচক: অন্য, অপর, পর ইত্যাদি

 

গ. বিশেষণ পদ : যে পদ দ্বারা বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি বুঝায়, তাকে বিশেষণ পদ বলে। যেমন– ভাল, মন্দ, বড়, ছোট, সামান্য, কিছু, দুটি, তিনটি ইত্যাদি বিশেষণ পদ।

বাক্যে প্রয়োগ
মাহিন ভাল ছেলে। (গুণ)
আমার দুটি জামা আছে। (সংখ্যা)
মিনা খুব দুষ্ট মেয়ে। (দোষ)
পুকুরে অনেক মাছ আছে। (পরিমাণ)

বিশেষণ পদের শ্রেণিবিভাগ :-

বিশেষণ পদকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –

১ – বিশেষ্যের বিশেষণ – অনেক, প্রচুর, ভালো, মন্দ প্রভৃতি।

২ – সর্বনামের বিশেষণ – সে খুব চালাক। তিনি বড়ো হত।

৩ – বিশেষণের বিশেষণ – খুব গরম, খুব ঠান্ডা, বড়ো ভালো।

৪ – অব্যয়ের বিশেষণ – ঠিক ওপরে, শতাধিক, শত ধিক, ঠিক নীচে।

৫ – ক্রিয়ার বিশেষণ – তাড়াতাড়ি দ্রুত হাঁটে, আমরা এখন খেলব।

বিভিন্ন বিশেষণ পদের সংজ্ঞা :-

১ – বিশেষ্যের বিশেষণ :

যে পদ বিশেষ্য পদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ, প্রভৃতি উপস্থিত করে তাকে বিশেষ্যের বিশেষণ বলে।

যেমন – মেঘলা আকাশ, বিদ্বান মানুষ, সাতদিন পরে সেচ্ছ অসুস্থ মানুষ, অনেক লোক, ভালো ছাত্রা

২ – সর্বনামের বিশেষণ :

যে বিশেষণ পদ কোনো সর্বনাম পদের গুণ, প্রকৃতি প্রভৃতি নির্ধারণ করে, তাকে বলে সর্বনামের বিশেষণ পদ ।

যেমন – বোকা তুমি, তাই ওদের কথা বিশ্বাস করলে। মূর্খ তুই, এ বছর কী বুঝবি।

৩ – বিশেষণের বিশেষণ :

যে বিশেষণ পদ অন্য একটি বিশেষণ পদের গুণ বা অবস্থা উল্লেখ করে তাকে বিশেষণের বিশেষণ বলে।

যেমন – খুব গরম দুধ। নিতান্ত ভালো মানুষ। অভি বড়ো নিম্নরে, একথা বলতে পারবে না।

৪ – অব্যয়ের বিশেষণ :

যে পদ কোনো অব্যয় পদের গুণ, অবস্থা, সংখ্যা ইত্যাদি প্রকাশ করে তাকে অব্যয়ের বিশেষণ বলে।

যেমন – শত ধিক্‌, ঠিক নীচে, ঠিক ওপরে রাখা আছে।

৫ – ক্রিয়ার বিশেষণ :

যে বিশেষণ পদ ক্রিয়ার গুণ, অবস্থা প্রভৃতি নির্ণয় করে, তাকে ক্রিয়ার বিশেষণ পদ বলে।

যেমন – সে তাড়াতাড়ি হাঁটে। বিমলা আস্তে আস্তে হাঁটে।

 

ঘ. অব্যয় পদ : যে পদের কোন পরিবর্তন হয় না, তাকে অব্যয় পদ বলে। যেমন– ও, এবং, আর, অথবা, কিন্তু, নতুবা, কিংবা, বাঃ, আহা! ইত্যাদি অব্যয় পদ।

বাক্যে প্রয়োগ
মিনা ও রিনা দুই বোন।
মনি অথবা জনি কাজটি করেছে।
রহিম এবং করিম স্কুলে যায়।
লোকটি গরিব কিন্তু সৎ।

অব্যয় পদের শ্রেনীবিভাগ :-

অব্যয় পদ প্রধানত তিন প্রকারের। যথা-

১ – পদান্বয়ী অব্যয়।

২ – অনন্বয়ী অব্যয় ও

৩ – বাক্যান্বয়ী বা সমুচ্চয়ী অব্যয়।

১ – পদান্বয়ী অব্যয় :

যে অব্যয় পদ বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হয়ে এক পদের সঙ্গে অন্য পদকে সংযুক্ত করে, তাকে পদান্বয়ী অব্যয় বলে।

যেমন- দুঃখ ছাড়া সুখ লাভ হয় না। তরুণ ও সুরেন আজ ক্রিকেট খেলবে। বাড়িতে আপনার কিন্তু আসা চাই।

ওপরে উল্লেখিত বাক্য তিনটিতে ছাড়া, ও, কিন্তু এই অব্যয় গুলি বাক্যের মধ্যে বসে একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদকে যুক্ত করেছে। অতএব এগুলো পদান্বয়ী অব্যয়।

২ – অনন্বয়ী অব্যয়

যে অব্যয় পদের সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের কোনো সম্বন্ধ থাকে না, তাকে অনন্বয়ী অব্যয় বলে।

যেমন—বাঃ! কী সুন্দর দৃশ্য! হায়! আমার কপালে কি এই ছিল। মা আমাকে আশীর্বাদ করো।

এখানে বা: হায়, মা—এই তিনটি পদ বাক্যের বাইরে বসে প্রশংসা, খেদ, সম্বোধন ইত্যাদি বুঝিয়েছে। এই পদগুলির দ্বারা মনের বিশেষ ভাব প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সবকটি ক্ষেত্রেই মূল বাক্যের সঙ্গে এদের কোনো সম্বন্ধ নেই।

৩ – বাক্যান্বয়ী বা সমুচ্চয়ী অব্যয় :-

যে অব্যয়, বাক্যে অন্বয় বা সম্বন্ধ তৈরি করে তাদের বাক্যান্বয়ী অব্যয় বলে।

বাক্যাম্বয়ী অব্যয়ের শ্রেনীবিভাগ :-

বাক্যাম্বয়ী অব্যয় ছয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা –

১ – সংযোজক অব্যয় :

সংযোজক অব্যয় যে অব্যয় পদ বাক্যের সঙ্গে বাক্যের বা পদের সঙ্গে পদের সংযোগ সাধন করে, তাকেই সংযোজক অব্যয় বলে।

২ – বিয়োজক অব্যয় :

বিকল্প বোঝাতে বাক্যের মধ্যে যে অব্যয় ব্যবহৃত হয়, তাকেই বিয়োজক অব্যয় বলে।

যেমন – হয় তুমি একাজ কর নয় তাকে কাজটি করতে দাও।

৩ – সংকোচক অব্যয় :

যে অব্যয় একটি বিষয়কে সংকুচিত করে কিন্তু অন্য বিষয়কে প্রাধান্য দেয়, তাকে সংকোচক অব্যয় বলে।

যেমন – এখন খেলা বন্ধ করে বরং পড়াশোনায় মন দাও। ভালো খেলোয়াড় হয়েছ জানি; তবুও মন দিয়ে পড়াশোনা করো।

৪ – হেতুবাচক অব্যয় :

কারণ বোঝাতে যে অব্যয় বাক্যে ব্যবহৃত হয় তাকে হেতুবাচক অব্যয় বলে।

যেমন – বাবা আমাকে মেরেছেন কারণ আমি তাঁর কথা শুনিনি।

৫ – সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় :

যে অব্যয়ের দ্বারা সিদ্ধান্ত বোঝায় তাকে সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় বলে।

যেমন – মশায় কামড়েছে তাই ম্যালেরিয়া হয়েছে।

৬ – নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় :

কতকগুলি অব্যয় আছে যারা একে অপরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত একটি বসলে অপরটি বসবেই।

যেমন – বটে কিন্তু, যেমন-তেমন, যখন-তখন, যেমনি কর্ম তেমনি ফল।

 

ঙ. ক্রিয়া পদ : যে পদ দ্বারা কোন কাজ করা বা হওয়া বুঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে। যেমন– যায়, খায়, পড়ে, লেখে, খেলে, আঁকে, দৌড়ায় ইত্যাদি ক্রিয়াপদ।

বাক্যে প্রয়োগ
মাহিন স্কুলে যায়।
মিনা বই পড়ে।
গরু ঘাস খায়।
ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে

 

 

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “পদ কী? পদ কয় প্রকার ও কী কী?” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

Similar Posts