শবে বরাত (Shab-e-barat) কি? পবিত্র কুরআন ও হাদিস অনুসারে শবে বরাতের গুরুত্ব

শবে বরাত ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। এই রাত অর্থাৎ শবে বরাত নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান রকম মত রয়েছে। কেউ শবে বরাতকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে রায় দিয়েছেন বা অ্যাখ্যায়িত করেছেন, আবার কেউ শবে বরাত পালন করা বা শাবান মাসের এই রাতে ইবাদাত করাকে বেদাত বা বিদায়াত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সবারই জানা দরকার শবে বরাত কী, কুরআন ও হাদিসে শবে বরাত নিয়ে কী বলা হয়েছে, শবে বরাত বেদাত/বিদায়াত কি না, শবে বরাতের ইবাদাত কী হবে। এই আর্টিকেলে শবে বরাতের গুরুতপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
শবে বরাত নিয়ে আলোচনার বিষয়ঃ–
  • শবে বরাত কী?
  • পবিত্র কুরআনে শবে বরাত নিয়ে যা বলা হয়েছে।
  • শবে বরাতের তাফসির
  • হাদিসে শবে বরাত নিয়ে যা বলা হয়েছে
  • শবে বরাত কি বেদাত (বিদআত)?
  • শবেবরাত বরকতময় রজনীর ইবাদত
শবে বরাত কী?
সহিহ হাদিসে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বা ‘শব-ই বারাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ শব্দের অর্থ ভাগ্য; শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী বা বরকতময় রজনী অথবা কল্যাণময় রজনী। কুরআনের -‘লাইলাতুল মুবারাকা’র অনুকুলে এটি পালিত হয়ে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।
পবিত্র কুরআনে শবে বরাত নিয়ে যা বলা হয়েছে
পবিত্র শবেবরাত, কুরআনে যাকে লাইলাতুল মুবারাকাতিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ৪৪ নম্বর সুরা ‘দোখানের’ ৩ নং আয়াতে ‘শবেবরাত বরকতময় রজনী’ উল্লেখ করার পূর্বে হা-মিম দিয়ে সুরাটির শুরু, যার অর্থ: হা- অর্থ হামদ, মিম দ্বারা মুহাম্মদ (সা.) অর্থাৎ ‘হামদে মুহাম্মদ (সা.)’ বা ‘চির প্রশংসিত মুহাম্মদ (সা.)’। যার পুরো অর্থ অনন্ত মুহাম্মদের প্রশংসিত সত্তার আত্মদর্শন। দ্বিতীয় আয়াতে ‘ওয়ালকিতাবিল মুবীন’ অর্থাৎ শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের উল্লেখ করে এর ওপর জোর প্রদান করা হয়েছে। সুরা দোখানের ১ ও ২ নং আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় অর্থাৎ অনন্ত প্রশংসিত মুহাম্মদের আত্মদর্শন করো আর শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের।
তারপর আল্লাহপাক শবেবরাতের কথা বললেন, ইন্না আনযালনাহূ ফী লাইলাতম্ মুবারাকাতিন্।
নিশ্চয়ই আমি এটি বরকতময় রজনীতে অবতীর্ন করেছি। [সুরা- দোখান, আয়াতঃ ৩]
আল্লাহর ঘোষণা হলো, নিশ্চয়ই এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে তামাশা করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে।
[সুরা-৪৪ [৬৪] দোখান, রুকু: ১, আয়াত: ১-১০, পারা: ২৫, পৃষ্ঠা ৪৯৬-৪৯৭/১৪-১৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। করআনের প্রায় সকল তাফসিরেই এর বর্ণনা রয়েছে।
শবে বরাতের তাফসির
প্রসিদ্ধ সকল তাফসির মতে, ‘শবে বরাতে’ অর্থাৎ ভাগ্য রজনীতে সকল মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, আগামী এক বছরের জন্য।
পবিত্র কুরআনের প্রসিদ্ধ তাফসীর গুলো থেকে রেফারেন্স পৃষ্ঠা নম্বরসহ শববরাতের দলিল উল্লেখ করা হলো:
তাফসীরে কাবীরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি (রহ.) সুরা দুখানের তাফসীর করতে গিয়ে ৯ম খন্ডে বিভিন্ন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলতে শাবানের ১৫ তারিখ শবেবরাত বলে উল্লেখ করেছেন।
অপর এক তাফসীরে রুহুল মাআনিতে আল্লামা আলূসী (রহ.) ২৫-২৬তম খন্ডে ১৪৮ পৃষ্ঠায় বৈরুত ছাপায় তিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী হজরত ইকরামা (রহ.) ও তাবেয়ীনদের এক বিরাট দলের মত উল্লেখ করে হাদিসের বর্ণনায় লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের বর্ণনা দেন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রজনীতে শবেবরাত বলে উল্লেখ করেন।
অপর এক তাফসীর তাফসীরে কাশশাফ চতুর্থ খন্ড ১৫৩ পৃষ্ঠায় একই বর্ণনা পাওয়া যায়।
অপর এক তাফসীর, কুরআনের প্রসিদ্ধ তাফসীর আল জামিউল আহকামে ইমাম কুরতুবী (রহ.) তাঁর তাফসীরের ৮ম খন্ড ৪৩২ পৃষ্ঠায় শবেবরাত সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন সুরা দোখানের লাইলাতুন মোবারাকাত প্রসঙ্গে।
হাদিসে শবে বরাত নিয়ে যা বলা হয়েছে
শাবান মাসের ১৪ তারিখকের দিবাগত রাতকে সহিহ হাদিস অনুসারে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ‘শবে বরাত’- কুরআনের যে আরবি শব্দটির অনুকূলে পালিত হয়ে আসছে তা হলো-‘লাইলাতুল মুবারাকা’। আমি পূর্বেই যার উল্লেখ করেছি। আবারও উল্লেখ করছি-
إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى” لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍۚ” إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ
অর্থ: নিশ্চয় উহা মোবারকময় একটি রাত্রির মধ্যে অর্থাৎ বরকতময়, কল্যাণময় বা বর্ধিষ্ণুতা দানকারী রাত্রির মধ্যে নাযিল করেছি।
হাদিস শরিফে যাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। এই মধ্যদিবস শাবান মাসের ১৫ তারিখ।
সিহা সিত্তার হাদিসে ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি শরিফের উদ্ধৃতি থেকে পবিত্র শবেবরাত সম্পর্কে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখ শবেবরাত উল্লেখ করে বেলায়েতের সম্রাট মাওলা হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (আ.) হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে, তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায়, ইবাদত-বন্দেগী করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কেউ কোন রিযক প্রার্থনাকারী আমি তাকে রিযক দান করবো। আছে কেউ কোন বিপদে আরোপিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করবো’। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। [ইবনে মাজাহ, বায়হাকী শরীফ]
শবে বরাত কি বেদাত (বিদআত)?
খুবই দুঃখের বিষয় হলো একদল তথাকথিত আলেম যারা এই বরকতময় রজনীর বিরোধিতায় লিপ্ত। তারা ফেসবুক, ইউটিউব বা ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বলছে, ‘শবে বরাত’ পালন করা বেদাত বা বিদায়াত বা বিদআত। আরও নানা কথা বলছে।
তারা কুরআনের যে সুরাটির যে আয়াত দ্বরা উদ্ধৃতি দিচ্ছে। সে সুরাটি কুরআনের ৯৭ নম্বর সুরার প্রথম আয়াত। অর্থাৎ ইন্না আনযালনাহূ ফী লাইলাতুল ক্বাদর অর্থ- আমি মহিমান্বিত রাতে এটি অবতীর্ন করেছি।
এবার আসুন বিশ্লেষণ করে দেখা যাক: সুরা দোখান কুরআনের ৪৪ নং সুরা আর কদর (ক্বাদর) কুরআনের ৯৭ নং সুরা।
অবতীর্ন ও বর্ণনার দিক থেকে সুরা দোখানের মতে পবিত্র কুরআন শবেবরাতের রজনীতে লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ন হয়। এবং সুরা ক্বাদরের বর্ণনা মতে এটি রমজান মাসের শবেক্বদরের (শবেকদর) রজনীতে প্রথম আসমান থেকে পৃথিবীতে জিবরিল মারফত মহানবির ওপর নাযিল হয়। এবং দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে একের পর এক আয়াত নাযিল হতে থাকে। তাহলে দেখা গেল, দুটি সুরার দুটি আয়াতের বর্ণনার মাঝে কোনো প্রকার বিরোধ নেই। এবং একটি আরেকটির পরিপূরক বা সম্পূরক আয়াত। আর হাদিসে ও কুরআনের অসংখ্য তাফসীরে এ বিষয়টির সুস্পষ্ট বিবরণ এভাবেই দেয়া হয়েছে, যেভাবে আমি উল্লেখ করেছি, কিন্তু তারপরও কিছু জ্ঞানপাপী আলেম এই মহা বরকতময় রজনীর বিরোধীতা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রজনীর ইবাদত থেকে বঞ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, জানি না তাদের উদ্দেশ্য কি? তবে তাদের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের এই বরকতময় রজনীর ইবাদতে মশগুল হয়ে আল্লাহর অসীম দয়া, রহমত, বরকত ও নাজাতের উসিলা অবলম্বন করতে আহ্বান জানাচ্ছি।
[শবেবরাতকে যারা বেদাত বা নাজায়েজ বলে তারা সুরা দোখানের সুস্পষ্ট আয়াতের অপব্যাখ্যা করে নিজেরাই বেদাত, কাফের, মুরতাদে পরিণত হয়েছেন]
শবে বরাত বরকতময় রজনীর ইবাদত
এই রাতের এশার নামাজের পর থেকে জায়নমাজে বসে-
  • ইস্তেগফার যতটা করা সম্ভব করা যাবে।
  • কমপক্ষে ৭ বার, সুরা ফাতিহা ৫ বার, সুরা ইখলাছ কমপক্ষে ৭ বার এবং যেকোনো দুরূদ শরীফ কমপক্ষে ১১ বার।
  • জায়নামাজে বসে খানিকটা সময় জিকির আযকার। মোরাকাবা মোশাহাদা।
  • বেশী সময় ইবাদত করতে চান তারা রাত ১২ বার পর থেকে কমপক্ষে ১২ রাকাআত নফস নামাজ পড়তে পারেন। এই নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহার পর কমপক্ষে তিনবার সুরা ইখলাছ পাঠ করে দুই রাকাত করে পড়তে হবে। ৬ বৈঠকে ১২ রাকাত।
  • তাহাজ্জুদ নামাজও আদায় করতে পারেন।
এভাবে যত গভীর রাত পর্যন্ত ইবাদত করা যায় ততই কল্যাণ ও সাওয়ার লাভ হবে ইনশাআল্লাহ। মুনাজাতের মাধ্যমে ইবাদাত শেষ করা ভালো।

এই আর্টিকেল সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানান।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *