কুরবানি কি?
কুরবানি মূলত করা হয় ঈদ-উল-আযহা এর সময় পশু উৎসর্গের মাধ্যমে।
আরবি (قربانى), কুরবান অথবা আদ্বহা বা আযহা ( أضحية) কে ইসলামিক শরিয়তে আইন হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
মহান আল্লাহ তা’আলা সুরা হজ্জে ইরশাদ করেন: ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : আয়াত ৩৪)
কুরবানি অর্থ কি?
‘কুরবানি’ এর অর্থ হলো- ত্যাগ, নৈকট্য লাভ, আত্মউৎসর্গ ইত্যাদি।
ইসলামি মতে কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে অর্থ্যাৎ জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা।
কুরবানির ইতিহাস কি?
মানবসম্প্রদায়ে ইতিহাসের প্রথম কোরবানী দাতা হলেন আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল (রা.) ও কাবিল।
আদি পিতা আদম (আ.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর নামে কোরবানি করো, যার কোরবানি কবুল হবে, তার দাবি গ্রহণযোগ্য হবে।’
তারপর তাঁরা উভয়ে কোরবানি দিলেন। হাবিল (রা.)-এর কোরবানি কবুল হলো।
এই প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান।
যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না।…অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কুরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
এর মাধ্যমেই বুঝা যায় যে, কুরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন হয়।
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি না করে লোক দেখানোর জন্য এবং নিজের সম্পদ প্রদর্শন এর জন্য কুরবানি করেন বা কোনো ইবাদত করেন তবে আল্লাহ তা’আলা তা কবুল করেন না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’ আলা বলেন: ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি।
যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর সব সময় যেন মনে রাখে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য।
অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও।
আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে আর আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫)
কুরবানির প্রচলন:
আমাদের আজকের এই মুসলিম সমাজে যে কুরবানির প্রচলন দেখা যায় তা মূলত জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ থেকে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর যখন শতবর্ষ বয়স তারপর আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, সেই কলিজার টুকরা সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কুরবানির সূত্র ধরে আজও সেই কুরবানীর বিধান প্রচলিত রয়েছে।
তখন হজরত ইবরাহিম (আঃ) তার পুত্র ইসমাইলকে বললেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি।
এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি? সে (হজরত ইসমাইল আঃ) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন।
আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)
এর পর আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কুরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে।
ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদের পুরস্কৃত করি।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)
আল্লাহ তা’আলা স্বপানাদেশ এর মাধ্যমে ইবরাহীম (আ.) এর পরীক্ষা নিয়েছেন ছেলেকে কুরবানির আদেশ দিয়ে।
যখন তিনি সেই পরীক্ষায় সফল হলেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ পুত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হলেন তখন আল্লাহ তা’ আলা সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে অন্য পশু জবেহ করে পুরস্কৃত করলেন ইবরাহীম (আ.) কে।
আর এইভাবেই প্রতিটি সৎ কর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকেন মহান আল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন ইবরাহিম (আঃ) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৪)
কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-
১. তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও পশু কুরবানি করো। ( সূরা কাওসারঃ ২)
২. বল, আমার নামাজ, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। তার কোনো অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল ( সূরা আল আন-আম: ১৬২-১৬৩)
কুরবানির ফজিলত:
কুরবানির ফজিলত অনেক যার কোনো সীমা নেই।
মহানবী সা: বলেছেন, ‘কুরবানির সময় আল্লাহর নিকট কুরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোনো জিনিস নেই।
কুরবানির সময় কুরবানিই সবচেয়ে বড় ইবাদাত।
কোরবানি জবেহ করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোঁটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই কুরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।’ (তিরমিজি)
মহানবী (সা:) তিনি আরো বলেছেন, ‘কুরবানির জানোয়ারের যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একেকটি নেকি লেখা হয়।’
অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘তোমরা মোটা ও তাজা জন্তু দিয়ে কুরবানি করো, কারণ উহা পুলসিরাতে তোমাদের সাথী হবে।’ (মেশকাত)
তাই আমরা যারা আমাদের সামর্থ্য আছে তারা প্রত্যেকেই চেষ্টা করবো আল্লাহকে খুশি করার জন্য কুরবানি করতে।
আর আল্লাহ তা’ আলা সবচেয়ে বেশি খুশি হন কুরবানির সময় কুরবানি করলে।
কুরবানির পশুর ধরণ:
১। কুরবানির পশু মূলত হতে পারে বকরি, পাঁঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় ধরনের জন্তু।
২। এই জন্তু গুলোর বয়স হতে হবে পূর্ণ ১ বছর। এর কম হলে তা দিয়ে কুরবানি আদায় হবে না।
৩। শিংহীন জন্তু বা শিং উঠেছে কিন্তু ভেঙে গেছে, খাসি বানিয়ে দেয়া জন্তু বা জন্তুর গায়ে বা কাঁধে অল্প দাঁদ বা খুজলি হয়েছে এ রূপ জন্তু দ্বারা কোরবানি বৈধ।
৪। কিন্তু ছয় মাসের বেশি বয়সী কোনো দুম্বার বাচ্চা যদি মোটা তাজা হওয়ার কারণে এক বছরের বাচ্চার ন্যায় মনে হয় তবে তা কুরবানি করা বৈধ বলে গন্য হবে।
৫। যেগুলো বড় প্রানী যেমন- গরু, মহিষ এগুলোর বয়স কমপক্ষে দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে।
৬। কোরবানির পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিনন্দন হতে হবে।
যেসকল কারণে কুরবানি বৈধ হবে না-
১। অন্ধ, কানহীন জন্তু কিংবা একটি কানের বা লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তারচেয়ে বেশি কেটে গেছে অথবা মূল থেকে ভেঙে যাওয়া শিংওয়ালা জন্তুর দ্বারা কুরবানি বৈধ হবে না।
২। অনুরূপভাবে অতি কৃশকায়, দাঁতহীন জানোয়ার, তিন পায়ে ভর দিয়ে চলে এমন বা খোঁড়া জন্তু দ্বারা কুরবানি করা বৈধ হবে না।
৩। অন্যদিকে হরিণ, বক ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তু হওয়া সত্ত্বেও এদের দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না।
৪। ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি কোনো কারণে কুরবানি করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তবে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কুরবানি করতে হবে।
কুরবানি করার নিয়ম:
কুরবানির পশুকে কেবলার দিকে মুখ করে শুইয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে জবেহ করতে হবে।
কুরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক বা জরুরি নয়।
যদি মনে থেকে থাকে তবে কুরবানির জন্য নির্ধারিত দোয়া পড়া যেতে পারে।
ক্রয়কৃত জন্তুর বাচ্চা হলে ওই বাচ্চাকে কোরবানি করে গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে, নিজে খাওয়া যাবে না।
সেই বাচ্চাকে জবেহ না করে গরিবকে দান করে দেয়া যেতে পারে।
আশা করছি কুরবানি সম্পর্কে আপনাদের সম্পূর্ণ ধারনা দিতে পেরেছি।
লিখাটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে নিজের আত্মীয় পরিজনের সাথে শেয়ার করে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ