মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানে বিজয় বা সাফল্যের কারণ বর্ণনা কর

ভূমিকা : অষ্টম শতকে মুহাম্মদ বিন কাশিম সর্বপ্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে ভারত অভিযান করলেও তার মৃত্যুর কারণে ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।

এরপর গজনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করলেও তিনি কোনো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেননি।

পরবর্তীতে মুহাম্মদ ঘুরী ভারত আক্রমণে মনোনিবেশ করেন । তিনি সুলতানমাহমুদের মতো যুদ্ধে বার বার সফলতা অর্জন না করলেও ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

ঐতিহাসিক মো. মোহর আলী বলেছেন, “Repeated attacks of sultan Mahmud had shaken the very foundation of this aristocracy and final collapse caused by the Ghuri attacks.”

মুহাম্মদ ঘুরী তাঁর সুকৌশল যুদ্ধরীতি ও নিজ মেধা দ্বারা ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সাফল্যের কারণ : কয়েকটি যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরী পরাজয়বরণ করলেও সামগ্রিকভাবে তিনি ভারতে সফলতা অর্জন করেন।

নিচে মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সাফল্যের কারণ বর্ণনা করা হলো :

১. ঘুরীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দূরদর্শিতা : মুহাম্মদ ঘুরী উচ্চোকাঙ্ক্ষী ও দূরদর্শী শাসক। তিনি ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি পৃথ্বীরাজের সাথে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজয়বরণ করে দমে না গিয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে রাজ্য অধিকার করেন।

২. সংগঠিত মুসলিম বাহিনী : মুহাম্মদ ঘুরীর নেতৃত্বে খুব রাজ্যের দুর্ধর্ষ আফগান মুসলিমগণ এক সুসংঘবদ্ধ সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়।

তাদের সংগঠিত বাহিনী ও সংহতির চেতনা ঘুরীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করে। মুসলমানদের মধ্যে | অধিকতর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও একতা ছিল। তাই তারা মুহাম্মদ ঘুরীর সুযোগ্য নেতৃত্বে যুদ্ধে সফলতা অর্জন করে।

৩. ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক অনৈক্য : ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য ও রাজন্যবর্গের পারস্পরিক বন্ধ ও সংঘর্ষ | মুহাম্মদ ঘুরী তথা মুসলমানদের বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। ভি. ডি. মহাজন বলেন, ‘A very important cause of Muslim success and Hindu failure was the lack of political unity in the country. (The Sultanate of Delhi. Page 78)

৪. কঠোর জাতিভেদ প্রথা : কঠোর জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণ বৈষম্য হিন্দুদের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু জাতিগোষ্ঠী রাজ্যাভিমানী হিন্দু রাজাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।

৫. সামন্তপ্রথা হিন্দু রাজপুত : সমাজে সামস্তপ্রথার প্রচলন তাদের সামরিক দুর্বলতার অন্যতম কারণ ছিল। হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যমান সামন্তপ্রথার কারণে সংঘটিত সামরিক দুর্বলতার জন্য হিন্দুরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আর | মুসলমান শক্তি এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুদের পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হন।

৬. হিন্দুদের গতানুগতিক যুদ্ধপদ্ধতি : হিন্দুদের চিরাচরিত হস্তিবাহিনীর ব্যবহার যুদ্ধে পরাজয়বরণের অন্যতম কারণ ছিল। মুসলিমদের মধ্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও একতা ছিল। সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল ও একতাবদ্ধ থাকায় মুহাম্মদ ঘুরীর যোগ্য | সামরিক নেতৃত্বে ভারত অভিযানে জয়যুক্ত হন।

৭. মুসলিম বাহিনীর সামরিক কৌশল : সৈন্য পরিচালনায় অপূর্ব দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার খণেই মুহাম্মদ ঘুরী যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। তাদের উন্নত রণকৌশল নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্র হিন্দু বাহিনীর সাথে যুদ্ধে সফলতার চাবিকাঠিরূপে প্রমাণিত হয়।

৮. ইসলামি আদর্শ : ইসলামি আদর্শ জমিনে প্রতিষ্ঠিত থাকবে এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুসলমানরা ভারতে আগমন করেছিল। গজনি থেকে আগত সেনাবাহিনীর সাথে সুফি ও পীর ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য ভারতে আগমন করেন।

তারা তাদের আদর্শের দ্বারা হিন্দুদের আকৃষ্ট করেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা বৈষম্যে দ্বারা অতিষ্ঠ হয়ে ইসলামের সুমহান অমীয় বাণী গ্রহণ করেন।

৯. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা : ভারতীয়দের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য ও অরাজকতার দরুন ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজন্যবর্গের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা প্রভৃতি মুহাম্মদ ঘুরীকে ভারতে অভিযানে সাহায্য করেছে।

১০. ভারতীয়দের সামরিক দুর্বলতা : ভারতীয়দের সামরিক শক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। রাজন্যবর্গদের যুদ্ধ কৌশল ছিল সেকেলে এবং সামরিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত দুর্বল।

ভারতীয়দের সামরিক শক্তি ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত লোকজন ও হস্তিবাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিল। হিন্দুদের সামরিক দুর্বলতার সুযোগে মুহাম্মদ ঘুরী সহজেই। তার শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারত জয় করতে সমর্থ হন ।

১১. ভারতীয়দের যোগ্য নেতৃত্বের অভাব : মুহাম্মদ ঘুরীর সুযোগ্য নেতৃত্বে সংগঠিত মুসলিম বাহিনী দুর্বল ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হিন্দুবাহিনীকে পরাজিত করে। ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে তেমন কোনো যোগ্য নেতৃত্ব ছিল না। হিন্দুদের এই অযোগ্য নেতৃত্ব মুসলমান শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকতে পারেনি।

১২. মূল্যায়ন : মুহাম্মদ ঘুরী প্রতিভাবান, বাস্তববাদী, দূরদর্শী, ন্যায়পরায়ণ, প্রজাহিতৈষী, অধ্যবসায়ী ও ভাবাবেগবর্জিত মুসলিম ছিলেন। মধ্য এশিয়ায় ও ভারতে কয়েকবার পরাজয় বরণ করেও তিনি নিরুৎসাহী হননি।

অদম্য সাহস, অসীম ধৈর্য এবং অভিনব ও উন্নত যুদ্ধ কৌশলের কারণে আফগানিস্তান হতে এসে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে উক্ত সাম্রাজ্যে একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুহাম্মদ ঘুরী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। অধিকাংশ যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করলেও প্রাথমিকভাবে বেশকিছু যুদ্ধে পরাজয়বরণ করেন।

ড. এ.বি.এম. হাবিবুল্লাহ বলেন, “There could be no two opinions as to the place Muizuddin should occupy in history. Unlike Mahmud Ghazni he was a practical statsman of the rotten political structure of india he tooks look the fullest advantage.”

মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের কারণ গুলো আলোচনা

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানে বিজয় বা সাফল্যের কারণ বর্ণনা কর” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

Similar Posts