সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর এক আকর্ষণীয় চরিত্র উক্তিটি যথাযথ মূল্যায়ন কর । বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি আলোচনা কর।
বাবরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি আলোচনা কর।
ভারতবর্ষের শাসকবর্গের ইতিহাসে যার নাম সর্বামে উচ্চারিত হয় তিনি হচ্ছেন জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। বাবর শুধুমাত্র একজন শাসকই ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নানা প্রতিভার অধিকারী।
বাল্যকালেই বাবরের শাসনকার্য পরিচালনার হাতেখড়ি হয়। তবে বাবরের সমগ্র জীবন সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর জৌলুসে ভরা ছিল না।
ছোটবেলা থেকেই বাবর নানারকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে বড় হয়েছেন এবং কিভাবে প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে নিজেকে চালিয়ে নিতে হয় তা রপ্ত করেছেন। আর এ শিক্ষাই তাকে সাফল্য এনে দেয়। তিনি ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করেন মুঘল সাম্রাজ্য।
→ বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী। বলা হয়ে থাকে যে একজন শাসকের যে সকল চারিত্রিক গুণাবলি থাকার দরকার তার সবকটিই বাবরের মধ্যে রয়েছে।
নিম্নে বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি আলোচনা করা হলো :
১. অত্যন্ত ধৈর্যশীল : বাবরের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে প্রথম ও প্রধানতম চরিত্রিক গুণাবলি হচ্ছে তার ধৈর্যশীলতা। বাবর সকল ক্ষেত্রেই ধৈর্য্যের পরিচয় দেন।
তাড়াহুড়া করে কোনো কাজ করতে গিয়ে তিনি কখনই ধৈর্যহারা হননি। এমনকি জীবনের প্রথম দিকে বাবর যখন ছন্নছাড়া জীবনযাপন করতেন তখনও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ।
২. সুউচ্চ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন : বাবর ছিলেন সুউচ্চ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। তার বিচার করার ক্ষমতা ছিল অসামান্য। তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন।
বাবরের উন্নত রণকৌশলের কাছে তথা বুদ্ধির কাছে শত্রুরা সহজেই ধরাশায়ী হতো। মধ্যযুগে তার মতো এত সুউচ্চ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি আর কেউ ছিল না।
৩. কঠোর অধ্যবসায়ী : বাবরের চারিত্রিক গুণাবলির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তার কঠোর অধ্যবসায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন কঠোর অধ্যবসায়ী।
তিনি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য আগে থেকেই সাধনা করতেন। আমরা দেখতে পাই যে, লাহোর জয় করার পর বাবর দিল্লি আক্রমণ করার জন্য দিন গোনছিলেন এবং সবকিছু জেনে বুঝেই অগ্রসর হচ্ছিলেন।
৪. নিপুণ যোদ্ধা : বাবর ছিলেন একজন সুনিপুণ যোদ্ধা। সে | সময়ে তার মতো যুদ্ধে পারদর্শী আর কেউ ছিল না। তিনি সব সময় তার সৈন্যবাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন এবং নিজেও প্রাণপণ যুদ্ধ করতেন।
তার যুদ্ধকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমণ এবং শত্রুপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। বাবর যুদ্ধে উন্নত যুদ্ধসামগ্রীর যথাযথ ব্যবহার করতেন। তাই আমরা দেখতে পাই যে, অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে বাবর ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
৫. সুদক্ষ শাসক : বাবর ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক তিনি ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। তিনি ভারতবর্ষে দুর্বল মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত সার্বভৌম একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
শুধু তাই নয়, শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাবর বেশ কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নে যথযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি অনেক আফগান শাসনরীতি অপরিবর্তিত রাখেন।
৬. প্রজাহিতৈষী : বাবর ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক। তিনি তার পূর্বপুরুষদের মতো রক্তপিপাসু ছিলেন না। তিনি সর্বদা প্রজাদের উন্নয়নের জন্য তথা প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন।
বাবরের শাসনামল পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, মাত্র ৪ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি পুকুর খনন, স্থাপত্য নির্মাণ, বাগান তৈরি প্রভৃতি নানা জনকল্যাণমূলক কাজ করেন।
৭. উদার ও অসাম্প্রদায়িক : বাবর ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতির। তিনি সবসময় বিজিত শত্রুদের প্রতি উদারতা দেখাতেন এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তিনি কোনোপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা দেখাতেন না। তিনি তুর্কি, আফগান ও হিন্দুদেরকে প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত করেন।
শুধু তাই নয় তারই শত্রু দৌলত খান লোদীর পুত্র দিলওয়ার খান লোদীকে খান-ই- খানান উপাধি প্রদান করেন এবং তার আরেক শত্রু চান্দেরীর মেদিনী রাওয়ের দুই কন্যাকে তার দুই পুত্রের সাথে বিয়ে দেন। যা তার উদারতাকেই ফুটিয়ে তুলে।
৮. হৃদয় জয় করার ক্ষমতার অধিকারী : বাবরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক গুণ ছিল তিনি অতি সহজেই সকলের হৃদয় জয় করতে পারতেন।
বিশেষ করে বাবর তার সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকটি সৈন্যের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সৈন্যদেরকে নানারকম উপদেশ দান করে তাদের উদ্দীপনা বাড়িয়ে তুলতেন।
৯. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল : বাবর ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় পর্যায়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি কখনোই আইন অমান্য করতেন না। এমনকি প্রজাদেরকেও আইন মান্য করার ব্যাপারে উপদেশ দিতেন।
তিনি ভারতবর্ষের বিগত শাসকদের আমলে প্রণীত অধিকাংশ আইন অপরিবর্তনীয় রাখেন এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য নতুন নতুন আইন তৈরি করেন।
১০. স্নেহশীল : বাবর ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল ও কোমল মনমানসিকতার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন স্নেহময় পিতা, মহান ও প্রজাবৎসল শাসক।
তার মাতৃভক্তি ও সন্তান বাৎসল্য ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। তিনি তাঁর ভাই, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। খেলাধুলাও তার অনেক পছন্দ ছিল।
১১. প্রকৃতি প্রেমিক : বাবর ছিলেন একজন প্রকৃত প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি কৃত্তিমতাকে বাদ দিয়ে প্রকৃতিকে ভালো বাসতেন। বাল্যকালেই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সমরকন্দ জয়ের স্বপ্ন দেখতেন।
শুধু তাই নয় তিনি তার রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো বাগিচা তৈরি করেন। যার বেশির ভাগই ছিল ঔষধী গাছের ও ফুলের। তিনি মৃত্যুর পর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত কাবুলের এক মনোরম উদ্যানে শায়িত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ।
১২. সাহিত্যানুরাগী : সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ বাবরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক গুণ। তার সাহিত্যানুরাগ ছিল প্রগাঢ়। তিনি তুর্কি ভাষায় দিওয়ান নামক কবিতার সংকলন রচনা করেন।
ফারসি ভাষাতেও বাবর ছিলেন সমান দক্ষ। তুর্কি ভাষায় লিখিত তার আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-বাবর’ তার অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন। যা মানব ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাবর ছিলেন মিশ্রিত এক উন্নত চরিত্রের অধিকারী। তিনি যেমনি ছিলেন যোদ্ধা তেমনি ছিলেন কৌশলী এবং বিদ্বান। একজন উন্নত ও যথার্থ শাসকের যেসব চারিত্রিক গুণাবলি থাকা দরকার তার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে তার চরিত্রে।
বিশেষ করে তার উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য সারাজীবন শিক্ষণীয় একটি বিষয়। আর এজন্যই বলা হয়, সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর এক আকর্ষণীয় চরিত্র।
শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর এক আকর্ষণীয় চরিত্র উক্তিটি যথাযথ মূল্যায়ন কর ” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।