HISTORY

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কি? বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

1 min read

ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কি

পলাশি যুদ্ধের পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তা ইতিহাসে ফকির-সন্ন্যাসি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হলো আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ সাল) সংগঠিত সন্ন্যাসী ও ফকির তাপসদের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন
আন্দোলনটি ১৭৬০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর স্থায়ী ছিল। কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রথম ফকিররা বিদ্রোহ শুরু করলেও পরবর্তীতে সন্ন্যাসিরা এতে যুক্ত হয়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মজনু শাহ এবং ভবানী পাঠক
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সূচনা হয় ঢাকায়। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের দু’জন নেতা ছিলেন মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক। দেবী চৌধূরাণী ছিলেন ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম মহিলা নেতা যিনি বিদ্রোহে ভবানী পাঠকের সাথে নেতৃত্ব দেন। ১৭৬০ সালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সর্বপ্রথম শুরু হয়
এই বিদ্রোহ রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে, ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের তীব্রতা ছিল মূলত উত্তর বঙ্গে। এই সব অঞ্চলে ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্রোহী ফকির-সন্ন্যাসীদের বহু সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এসব সংঘর্ষে বিদ্রোহীদের আক্রমণে অনেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয় এবং ফকির-সন্ন্যাসীরা কোম্পানির বহু কুঠি লুট করে নিয়ে যায়।

ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কারণ

মূলত চারটি প্রধান ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়। যারমধ্যে ছিল,
  1. ইংরেজ কর্তৃক ফকির-সন্ন্যাসীদের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা।
  2. ফকির-সন্ন্যাসীদের ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহ করাকে বে-আইনী ঘোষণা করা।
  3. ফকির-সন্ন্যাসীদের দস্যু-ডাকাত বলে আখ্যায়িত করা।
  4. ১৭৭১ সালে ১৫০ জন ফকিরকে বিনা কারণে হত্যা করা।
সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ধার্মিক ফকিররা তাদের পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করতেন। পথে এসব সন্ন্যাসীগণ গোত্রপ্রধাণ, জমিদার অথবা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। গোত্রপ্রধান ও জমিদারগণও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ছিলেন।
কিন্তু যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই অঞ্চলের দেওয়ানী ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে স্থানীয় ভূস্বামী ও গোত্রপ্রধানগণ সন্ন্যাসী এবং ইংরেজ উভয়কেই কর প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়ে। উপরন্তু ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।
১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে দৃশ্যত বিনা কারণে হত্যা করা হয়। এটি ছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম কারণের একটি যা তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এই ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সশস্ত্র সংঘাতে।
হিন্দু সন্ন্যাসীরা একইভাবে তীর্থ ভ্রমণের পাশাপাশি অর্থ ধার দেয়ার সুযোগ কাজে লাগাত। ব্রিটিশদের কাছে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সন্ন্যাসীরা ছিল লুটেরা। ইংরেজদের কাছে ভ্রাম্যমান হিন্দু সন্ন্যাসীদের এই বিশাল স্রোত সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে হত। তাই ইংরেজরা এসব সন্নাসীদের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।

সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ

ব্রিটিশ বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দুর্বল নেতৃত্ব। ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর, ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল ক্রমশঃ আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।
১৭৮৭ সালে ফকির নেতা মজনু শাহ এবং সন্নাসী নেতা ভবানী পাঠকের মৃত্যুর পর যোগ্য ও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ফকির সন্নাসী বিদ্রোহ ধীরে ধীরে স্তমিত হয়ে যায়। এরপর, বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ, সোবানশাহ, চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ, এবং মাদার বক্স প্রমুখ ফকিরগণ। তারা পরবর্তী কয়েক বছর ইংরেজদের বিরদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে রাখে।
ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল অস্থায়ী বাসিন্দা। ফলে বিদ্রোহীরা স্থানীয়দের সহযোগিতা ও সহানুভূতি পেতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, ফকির-সন্ন্যাসীরা অস্ত্র, আধুনিক রণকৌশল, এবং উন্নত যোগাযোগ ইত্যাদির কারণে ইংরেজ সৈন্যদের সমকক্ষ ছিল না। ফলে, ইংরেজদের উন্নত, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, রণকৌশল, সামরিক প্রযুক্তি এবং বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে প্রাণপণ লড়াই করেও শেষে হেরে যায়। সর্বশেষ ১৮০০ সালে ফকির ও সন্নাসী নেতারা ইংরেজদের কাছে চুড়ান্ত পরাজিত হয়।
5/5 - (11 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x