সুদীর্ঘ ১৭৫ বছর পর, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে, ভার্সাইয়ের রাজসভায় স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার আয়োজন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে এ জাতীয় সভার আহবান অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। কারণ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো এদিন থেকেই। এ রাজসভায় তখন মোট সদস্য সংখ্যা ছিলো ১২১৪ জন। এর মধ্যে যাজকদের সংখ্যা ছিলো ৩০৮ জন, অভিজাতদের সংখ্যা ছিলো ২৮৫ জন ও তৃতীয় শ্রেণীর সংখ্যা ছিলো ৬২১ জন।
তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু এ সকল সদস্যদের একটি করে ভোট ছিলো না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোনো লাভ হয়নি তাদের। কেননা অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর বিরোধিতার জন্য রাজা তৃতীয় শ্রেণীর দাবি-দাওয়া মানতে রাজি হতেন না।
এভাবে কয়েকদিন অপেক্ষার পরে যখন রাজার কাছ থেকে কোন সন্তোষজনক উত্তর না আসে, তখন ১৭ জুন, স্টেটস জেনারেলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ নিজেদেরকে ফ্রান্সের জাতীয় সভা হিসেবে ঘোষণা করে এবং কর ধার্যের অধিকার নিজেদের হাতে তুলে নেন। তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মিরাবো ও আবেসিয়াস। এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর চাপের মুখে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদেরকে দমন করার সংকল্প করেন।
ফরাসি বিপ্লবের প্রারম্ভে টেনিশ কোর্টের শপথ ছিল অন্যতম ঘটনা। মূলত ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়েছিল এই শপথের মাধ্যমেই। দলগত ও মাথাপিছু ভোটের দ্বন্দ্বে রাজা ষোড়শ লুই জাতীয় মহাসভার বা স্টেটস জেনারেল অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তবে রাজার এমন সিদ্ধান্তের কথা তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ জানত না। ফলে তারা ২০ জুন এসে দেখেন সভাগৃহ বন্ধ রয়েছে এবং প্রবেশপথে বহু সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে উপস্থিত হন এবং সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানেই তারা ঐতিহাসিক শপথ নিয়েছিল যা ইতিহাসে টেনিশ কোর্টের শপথ নামে পরিচিত। শপথে ঘোষণা হয় যে,
‘‘যতোদিন তারা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারবেন ততোদিন পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন।’’
এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই ২৩ জুন স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহবান করে জাতীয় সভার কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণ বেআইনী বলে ঘোষণা দেন এবং প্রতিনিধি সভার তিনটি শ্রেণীকে পৃথক পৃথক কক্ষে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন। রাজার এ ঘোষণার ফলে সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। রাজার ঘোষণা শেষ হলে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর সদস্যরা সভাকক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা কক্ষ ত্যাগ করেন নি। সভাগৃহে রাজার পরিচালক তাঁদেরকে সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বললে মিরাবো দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দেন, “আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বল প্রয়োগ ছাড়া ভিন্ন অন্য কিছুতেই সম্ভব নয়।”
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা শেষ পর্যান্ত তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিগণকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার প্রদান করেন। রাজা কতৃক জনসাধারণের দাবি মেনে নেওয়ার ফলে তাঁদের প্রাথমিক সাফল্য লাভ হয়। এভাবেই ফরাসি বিপ্লবের গতি সহজ ও অপ্রতিহত হয়ে উঠলো। প্যারিস নগরী বিপ্লবের মঞ্চে পরিণত হলো।
বিপ্লবের প্রারম্ভে ফ্রান্সের গ্রাম অঞ্চলে কৃষির অবনতি ও প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ কাজ ও খাদ্যের সন্ধানে শহরে চলে আসে। এসময় ক্ষুধার্ত মানুষ প্যারিসে রুটির দোকান ও কারখানাগুলো আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ইতঃপূর্বে শহরে সশস্ত্র ডাকাত দলের আবির্ভাব ঘটে ও যত্রতত্র লুটতরাজ হলেও রাজা ষোড়শ লুই প্যারিস নগরীর আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়।
রাজা এরুপ আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিচলিত হয়ে ১৭৮৯ সালের ২৭ জুন ভার্সাই নগরীর নিকট সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। শুরু হয় জনতার সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ। এমতাবস্থায় প্যারিসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের হাতে চলে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড ও লুট হতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান।
১৪ জুলাই, ১৭৮৯ সালে, উন্মত্ত জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেয়। তারা বহু বন্দিকে মুক্ত করে। এই বাস্তিল দুর্গের পতনের সাথে সাথে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমাধি প্রতিষ্ঠা হয়।
এ দুর্গের পতনের সাথে সাথে প্যারিসের শাসনভার সাধারণ বিপ্লবীরা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তারা নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে ‘প্যারিস কমিউন’ নামে একটি অস্থায়ী পৌর পরিষদ গঠন করে। প্যারিস নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিপ্লবীরা ন্যাশনাল গার্ড নামে জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করে। প্যারিসের ন্যায় ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরণের কামিউন গঠিত হয় ।
বাস্তিল দুর্গ পতনের সাথে সাথে গ্রামের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। তারা ধ্বংস করতে থাকে শোষণের যাবতীয় হাতিয়ার। এসময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, শহর থেকে অভিজাতরা ভাড়াটিয়া লুটেরা পাঠিয়ে গ্রামের শস্যক্ষেত পুড়িয়ে দিচ্ছে।এর ফলে কৃষকরা নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয় ও তাদের সামন্ত প্রভুদের হত্যা করতে থাকে। কৃষকদের এই অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থানে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
১৭৮৯ সালের ৪ আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশন বসে। ১১ আগস্ট একাধিক আইন পাশ করে ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাত শ্রেণী তাদের সকল সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে দীর্ঘদিনের প্রাচীন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ও ফ্রান্সের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা হয়।