বাংলাদেশের সংবিধানের প্রকৃতি
লিখিত সংবিধান
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সংবিধান লিখিতভাবে থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ৮৩ পৃষ্ঠার একটি লিখিত সংবিধান। এতে শুরুতে রয়েছে ১টি প্রস্তাবনা। সংবিধানের মোট অধ্যায় বা ভাগ ১১ টি এবং অনুচ্ছেদ ১৫৩ টি। এছাড়া তফসিল রয়েছে ৪ টি।
সংসদীয় গণতন্ত্র
বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা হবে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে। মূলত প্রধানমন্ত্রি ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ দেশের প্রধান এবং প্রকৃত ক্ষমতার মালিক। সংসদ সদস্য, মন্ত্রি, এবং প্রধানমন্ত্রি পরিষদ সকল ক্ষেত্রে সংসদের নিকট দায়ী থাকেন। নির্দিষ্ট আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা
সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের সংবিধান হবে এক কক্ষ বিশিষ্ট্য। এতে নিম্মকক্ষ বা উচ্চ কক্ষ নামে কোন কিছু থাকবেনা। বাংলাদেশের এক কক্ষ বিশিষ্ট্য আইনসভার নাম হচ্চে ‘‘জাতীয় সংসদ।‘‘
৫০ টি সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ সংসদে আসন সংখ্যা ৩৫০ টি। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আসন থেকে ৩০০ জন সদস্য জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
সংবিধানে ৪ টি প্রধান রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বিধিবদ্ধ রয়েছে। যেমন, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চারটি নীতি দুষ্পরিবর্তনীয়। এছাড়া আরো অনেকগুলো মূলনীতি যেমন, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক নীতি, মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, মালিকানার নীতি, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা ইত্যাদি।
সংবিধানের মূলনীতি সমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ৮ থেকে ২৫ অনুচ্ছেদ পর্যন্তি এই নীতিগুলো সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধানের মূল স্তম্ভ রাস্ট্র পরিচালনার নীতি। প্রধান ৪ টি মূলনীতি সম্প্রসারিত হয়ে বাকি মূলনীতিগুলো লিপিবদ্ধ আছে।
- জাতীয়তাবাদ: সংবিধানের অন্যতম একটি মূলনীতি এই জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তা একটি ধারণা মাত্র। কোন জাতি বা গোষ্ঠীর ঐক্য ও সংহতির প্রবল অনুভূতি যা চেতনা তৈরি করে একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে অন্য একটি জনসমষ্টি হতে আলাদা করতে পারে তাই জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের কিছু প্রধান উপাদান যেমন ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খাদ্যভাব, এবং ভৌগলিক সীমারেখা। এগুলোর মাধ্যমে একটি জাতিকে অপর জাতি থেকে আলাদা করা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হবে ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। যে ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে।
- সমাজতন্ত্র: সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে মূলত একটি শোষণহীন, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ, সুবিধা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
- গণতন্ত্র: সংবিধানে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে সংগ্রাম করে আজ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত, সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হবে রাষ্ট্রে মূল স্তম্ভ। জনেগণের মোলিক অধিকার, ভোটাধিকার প্রয়োগ, এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সকল পর্যায়ে অংশগ্রহনের মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা হবে।
- ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্র নির্দিষ্টভাবে কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দিবেনা। সকল ধর্ম সমান ও সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। কোন ব্যক্তি তারঁর ধর্মের জন্য যেন কোনরুপ বৈষম্যের শিকার না হয় তার জন্য এই ধর্মনিরপেক্ষতা।
এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র: বাংলাদেশ হবে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এতে কোন অঙ্গরাজ্য থাকবে না।
দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। তবে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে প্রয়োজনে এর কিছু সংশোধন আনা যাবে।
মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি: রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইনের দ্বারা অধিকারগুলোর উপর যুক্তি সঙ্গত বাঁধা দিতে পারবে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো হচ্ছে ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, সরকারী নিয়োগ লাভে সুযোগ, সমাবেশের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সাম্যের অধিকার ইত্যাদি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা: সংবিধানে রাষ্ট্রপতির অধিকার সীমিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নামে মাত্র রাষ্ট্র প্রধান হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রির সাথে আলোচনা করে নিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। এছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রি নিয়োগ করতে পারবেন।
প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রে নাগরিককে সংবিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকার করেছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।’’
সর্বজনীন ভোটাধিকার লাভ: এই সংবিধান জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করে। জাতি, বর্ণ, ধর্ম, এবং নারী-পুরুষ, যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে তারা যে কোন নির্বাচনে ভোটাধিকার লাভ করবে।
জরুরী অবস্থা ঘোষণা: রাষ্ট্রের অন্তিম বা যুদ্ধাবস্থায় অথবা আইন শৃংখলা অবনতি হলে রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণার এখতিয়ার রাখে। একমাত্র রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের পরামর্শ অনুয়ায়ী জরুরী অবস্থা জাারি করতে পারবে। জরুরী অবস্থার সময় সংবিধান স্থগিত থাকে। এই সময় জনগনের মৌলিক অধিকার নিস্ক্রীয় থাকে।
নাগরিকের সার্বভৌমত্ব