বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কারা

বাংলাদেশের আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। অনেকেই তাদেরকে উপজাতি বলে সম্বোধন করে। কিন্তু তারা নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এসকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় নিজেদেরকে উপজাতি অথবা আদিবাসী বিতর্কের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন,

আদিবাসী এবং উপজাতির পার্থক্য

ইংরেজি  Indigenous people, যার অর্থ আদিবাসী। আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। যারা বহুকাল ধরে কোন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। আধুনিক জনগোষ্ঠীর জৈব ও সামাজিক প্রভাবজাত নয় এমন জনগোষ্ঠীকে মূলত আদিবাসী বলা হয়।
অন্যদিকে, উপজাতি এমন জনগোষ্ঠীগুলোকে বুঝায়, যারা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি কিন্তু নিজস্ব একটি আলাদা সংস্কৃতি গড়ে তুলেতে সমর্থ হয়েছে। মূলতঃ রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে জাতি বা উপজাতি নির্দিষ্টকরণ হয়ে থাকে।
নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের মতে, আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে দীর্ঘদিন থেকে বসবাসকারী প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী, যাদের উৎপত্তি এবং বিস্তার এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।

বাংলাদেশের উপজাতি সংখ্যা

বাংলাদেশে বর্তমানে উপজাতি বা আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে প্রায় ১৫ লক্ষ ৮৬ হাজারের মত। যা মোট জনসংখ্যার ১.০৩%। ছোটবড় মিলিয়ে বাংলাদেশে ৫০ টি উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করে, যাদের মধ্যে চাকমা আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি হচ্ছে সাঁওতাল।
উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাস করে পার্বত্য চট্টোগ্রামে। পার্বত্য চট্টোগ্রামে মোট ১৩ টি উপজাতি বাস করে। সমগ্র বাংলাদেশের উপজাতিদের ৫০% পার্বত্য চট্টোগ্রামে বাস করে। এছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী দিনাজপুর, এবং বরিশালে উপজাতিরা বসবাস করে।
উপজাতিদের অবস্থান
উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মগ, মুরং, খুমি, খিয়াং, চক, লুসাই, পাংখোয়া, কুকি, তঞ্চঙ্গা, এবং বনজোগী সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টোগ্রাম, চট্টোগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় বাস করে। সিলেট বিভাবে বসবাস করে খাসিয়া, মণিপুরি, পাঙন এবং মুন্ডা উপজাতি।
গারো এবং হাজং সম্প্রদায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা ময়মনসিং, নেত্রকোনা, শেরপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় বাস করে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া এবং দিনাজপুর বসবাস করে। এছাড়া রাখাইন উপজাতি সম্প্রদায় কক্সবাজার ও পটুয়াখালী জেলায় বাস করে।
ধর্ম
বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতীয়দের ধর্ম বৌদ্ধ। প্রায় জনসংখ্যার ৪৪ % বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদরে মধ্যে মারমা, চাক, চাকমা, রাখাইন, খিয়াং, খুমি তঞ্চঙ্গা অন্যতম। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আছে গারো, কোচ, হাজং, ত্রিপুরা, বর্মণ, পাংখোয়া, মাহাতো এবং খাড়িয়া সম্প্রদায়।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে খাসিয়া, লুসাই, মাহালী অন্যতম। মুন্ড এবং রাজবংশীদের ধর্ম প্রকৃতি পূজা। তারা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদির উপাসনা করে। উপজাতিদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় হচ্ছে পাঙন।
উপজাতি উৎসব
বিশেষ করে পার্বত্য চট্টোগ্রামের ৩ টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে একত্রে বলা হয় বৈসাবি উৎসব। ত্রিপুরা উপজাতিদের কাছে এটি বৈসুক, মারমাদের কাছে এটি সাংগ্রাই এবং চাকমাদের কাছে এটি বিঝু নামে পরিচিত। চাকমাদের ধর্মীয় উৎসবের নাম ফাল্গুনি পূর্ণমা। সাঁওতালদের প্রধান উৎসবের নাম সোহরাই বা বাহা। ওয়াংগালা উৎসব হচ্ছে গারো সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।
ত্রিপুরাদের উৎসবের নাম বৈসাবি যা একটানা তিন দিন ধরে পালন করা হয়। এই তিন দিনে পালিত অনুষ্ঠানগুলি হলো হারী বৈসু, বিসুমা বৈসু এবং বিসিকাতাল। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু পালন করা হয়। এই দিনে তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ীঘর সুন্দর করে লেপে মুছে, এবং পোশাক আশাক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে।
তারা একপ্রকার গাছের পাতার রস এবং হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ঘরবাড়ি ফুলদিয়ে সজ্জিত করে। শিশু কিশোররা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে এবং তাদের প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। তারা ভগমানের নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেয়।
মারমাদের উৎসব সাগ্রায় নামে পরিচিত। মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। তারা পহেলা বৈশাখের দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে। এছাড়া নানা ধরনের খাবারের আয়োজন করে থাকে ।
বিজু উৎসব চাকমাদের অন্যতম প্রধান বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বিজু অনুষ্ঠান তিন ভাগে ভাগ করে পালন করে। চৈত্রের ২৯ ফুল বিজু, ৩০ তারিখ মূল বিজু  এবং পহেলা বৈশাখের দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে।

Similar Posts