চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রনায়ক এবং আধুনিক চীনের জনক মাও সেতুং। তিনি বর্তমান চীনা সমাজ ও সংস্কৃতিতে ওতোপ্রোত ভাবে ছড়িয়ে আছেন।
মাও ছিলেন একজন লেখক, কবি এবং দার্শনিক। তার প্রচারিত দর্শন মাওবাদ হিসেবে চীন এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত, তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে জন্ম গ্রহণ করেন মাও সেতুং। ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৩ সালে চীনের হুনান প্রদেশের শাওশান নামক এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন কৃষক।
পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি কনফুসীয় মতবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। চীনে সেই সময় কিং রাজবংশের শাসন চলছিল। খুবই দুর্দশাগ্রস্থ শাসনের ফলে জনগণের জীবনযাপন ছিল খুব করুণ ও বেদনাদায়ক। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাও পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে কৃষিকাজে যোগ দেন।
১৭ বছর বয়সে হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশায় মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য বাড়ি ত্যাগ করেন। ১৯১১ সালে সিংহুয়া বিপ্লব রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় এবং মাও সেতুং বিপ্লবী সেনা এবং জাতীয়তাবাদী দল কুমিনতাংয়ে যোগ দেয়। এসময় চীনে কিং রাজবংশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মাও সে তুং ছয় মাস এই আন্দোলনে সেনা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।১৯১২ সালে, চীনা রাষ্ট্রপতি সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দল কুওমিনতাং রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।
১৯১৮ সালে মাও সেতুং হুনান ফার্স্ট স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেন। চাকরির সন্ধানে চীনের বেইজিং সফর করেন কিন্তু চাকরি পেতে বারবার ব্যর্থ হন। অবশেষে, মাও বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ পান এবং কয়েকটি ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে, তিনি সেখানকার অধ্যাপকের মেয়ে ইয়াং কাইহুইকে বিয়ে করেন।
মাও রুশ বিপ্লবে প্রভান্বিত হয়ে ১৯২১ সালে নতুন দল হিসেবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সদস্য হন। কমিউনিস্ট পার্টি দিন দিন শক্তিশালী হতে থাকে এবং তাদের দলে সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাও সেতুং কমিউনিস্ট এবং কুমিনতাং উভয় দলকেই তখন সমর্থন করতেন।
পরবর্তীতে, তিনি লেনিনীয় মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে কৃষক সমাজের বিকল্প নেই। মাও তখন দলের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য পদ লাভ করে এবং চীনের সাংহাই প্রদেশের নির্বাহী প্রধান হন।
১৯২৫ সালে, চীনের প্রেসিডেন্ট এবং কুমিনতাং দলের চেয়ারম্যান সান-ইয়াত সেন মারা যান। তার স্থলাভিষিক্ত হন চিয়াং কাইশেক। কাইশেক ছিলেন একটু বেশিই রক্ষণশীল। তিনি কমিউনিস্টদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাদের প্রতি বিরুপ সহিংস হয়ে উঠেন। চিয়াং কাইশেকের নির্দেশে কমিউনিস্ট পার্টির হাজার হাজার নেতা কর্মীদের গুলি করা হয়। অনেককে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছেন তিনি। এরপর থেকেই চীনে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়।
মাও তখন তাঁর গ্রামে শীতকালিন অবসর যাপন করছিলেন। তিনি কুমিনতাং সরকার বিরোধী কৃষক জনমত গঠন করেন। মাও সে-তুং কুওমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের একটি বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল কিন্তু তারা সহজেই পরাজিত হয়। সেনাবাহিনীর বাকি সদস্যরা জিয়াংজি প্রদেশে পালিয়ে যায়। যেখানে তারা পুনর্গঠিত হয়েছিল।
মাও জিয়াংজি পার্বত্য অঞ্চলে সোভিয়েত রিপাবলিক অব চায়না সরকার গঠন করেন এবং ১৯৩১ সালে এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।। তিনি গেরিলা যোদ্ধাদের একটি ছোট শক্তিশালী রেড আর্মি তৈরি করেন। এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার।
১৯৩৪ সালের মধ্যে জিয়াংজি প্রদেশে কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে দশটিরও বেশি অঞ্চল চলে যায়। চিয়াং কাই-শেক তাদের সাফল্য এবং ক্রমবর্ধমান সদস্য দেখে ঘাবড়ে যান। চিয়াং অঞ্চলটিতে কমিউনিস্ট প্রভাব দূরীকরণের জন্য ব্যাপক নিধন শুরু করে। অক্টোবরে, চিয়াং প্রায় এক মিলিয়ন সরকারী বাহিনী জড়ো করে কমিউনিস্টের দুর্গ ঘিরে ফেলে। মাও আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক হয়েছিল। তাই সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণ করার আগেই তিনি কৌশলে পশ্চাদপসরণ করেন।
১৯৩৭ সালে জাপান চীন আক্রমণ করে। চিয়াং কাইশেক তখন উভয়মুখি বিপদে পড়েন। এমন অবস্থায় তিনি কমিউনিস্টদের সাথে চুক্তি সম্পাদন এবং জাপানের বিরুদ্ধে তাদের সহায়তা কামনা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে, তাদের নিয়ন্ত্রিত চীন মুক্ত হয়ে যায়। ফলে চীনে আবারো গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর, মাও সেতুং বেইজিংয়ের তিয়ান আনমেন স্কয়ারে পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করে চীনে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দেন।