আমেরিকান গৃহযুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। গৃহযুদ্ধটি শুরু হয়েছিল আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির দাসপ্রথা প্রশ্নে উত্তরাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে।
নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সমাপ্তি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার মধ্যভাগে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সংঘাত। গৃহযুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি একক জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে এবং দাসত্বের অবসান ঘটায়।
১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল, ফোর্ট সাম্টারে কনফেডারেট বাহিনীর আক্রমণের মাধ্যমে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এই গৃহযুদ্ধ ৯ মে, ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ফেডারেল বাহিনী জিতেছিল। সংঘর্ষটি আমেরিকার মাটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ।
যাইহোক, প্রায় ৬২০,০০০ থেকে ৭৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে এই ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধে। এই যুদ্ধের মৃতের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য যুদ্ধের আমেরিকান মৃত্যুর চেয়ে বেশি। ব্যয়বহুল আমেরিকার এই যুদ্ধের প্রাথমিক কারণগুলির মধ্যে রয়েছে দাসত্বের ইস্যুতে দুই অঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব, এবং সার্বভৌম রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সমস্যা।
১৮৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। দাসত্ব, রাজ্যের অধিকার এবং পশ্চিমে দাসত্ব সম্প্রসারণের উপর উত্তর ও দক্ষিণ রাজ্যের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা উত্তেজনা গৃহযুদ্ধে রুপ নেয়। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকনের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দক্ষিণের সাতটি রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে আমেরিকান কনফেডারেট স্টেটস গঠন করে। এছাড়া আরও চারটি রাজ্য পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দেয়।
১৯৬১-৬৫ এর গৃহযুদ্ধ নির্ধারণ করেছিল যে আমেরিকা কোন ধরনের জাতি হবে। যুদ্ধটি দ্বারা আমেরিকার বিপ্লবের (১৭৭৫-১৭৮৩) অমীমাংসিত দুটি মৌলিক প্রশ্নের সমাধান হয়েছে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম রাজ্যগুলো নিয়ে একটি কনফেডারেশন হবে এবং সমস্ত মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীতদাস দেশ হিসাবে বিদ্যমান থাকবে।
গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত স্বাধীন ও দাস রাষ্ট্রের মধ্যে আপোষহীন পার্থক্যের কারণে। আব্রাহাম লিংকন ১৮৬০ সালে, প্রথম রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর, দাসত্ব প্রথাকে বিলুপ্তের প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে দাসপ্রথা কেন্দ্রীক দক্ষিণে সাতটি রাজ্য পৃথক হয়ে একটি নতুন জাতি গঠন করে। যার নাম দেওয়া হয় আমেরিকান কনফেডারেট স্টেটস।
লিঙ্কন প্রশাসন এবং উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ আমেরিকার বিচ্ছিন্নতা মেনে নিতে পারেনি। তারা আশঙ্কা করেছিল যে, এটি মার্কিন গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করবে এবং একটি মারাত্মক অবস্থা তৈরি করবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কয়েকটি ছোট ছোট দেশে বিভক্ত করবে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করে। সেই সময় দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি মৌলিক অর্থনৈতিক পার্থক্য এবং বৈষম্য দেখা দেয়। উত্তরে রাজ্যগুলোর উৎপাদন এবং শিল্পকারখানায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা কৃষি ক্ষেত্রে স্বল্প খামারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে, দক্ষিণের রাজ্যগুলোর অর্থনীতি ছিল বিশাল চাষাবাদের উপর ভিত্তি করে।
তারা কৃষির জন্য কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের শ্রমের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। দক্ষিণে কৃষি প্রধান রাজ্যে তুলা এবং তামাক চাষ হত। ১৮৩০ সালের পরে, উত্তরের রাজ্যগুলোর ক্রমবর্ধমান দাসত্ব প্রথা বিলোপবাদী মনোভাব দেখা যায়। এছাড়াও নবগঠিত পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় দাসপ্রথার সম্প্রসারণ প্রশ্নে উত্তরে বিরোধিতা করে। ফলে দক্ষিণাঞ্চল আমেরিকায় দাসত্বের অস্তিত্ব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে।
১৮৫৪ সালে, মার্কিন কংগ্রেস কানসাস-নেব্রাস্কা আইন পাস করে। যা মূলত কংগ্রেসের আদেশে সমস্ত নতুন অঞ্চল দাসত্বের জন্য উন্মুক্ত করে। কিন্তু উত্তরের রাজ্যগুলো এই আইনের বিরোধিতায় করে, এবং পশ্চিমাঞ্চলে দাসত্বের বিস্তারের নীতির বিরোধিতার উপর ভিত্তি করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি গঠন করে।
১৮৫৭ সালে, ড্রেড স্কট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, অঞ্চলগুলিতে দাসত্বের বৈধতা নিশ্চিত করে। ১৮৬০ সালের নভেম্বরে আব্রাহাম লিংকনের নির্বাচনে জয়ের তিন মাসের মধ্যে, সাতটি দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য দক্ষিণ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুইজিয়ানা এবং টেক্সাস যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
১২ এপ্রিল, ১৮৬১ সালে, চার্লসটন বে এর ফোর্ট সাম্টারে কনফেডারেট সেনাবাহিনী ফেডারেল বাহিনীর উপর প্রথম গুলি চালায় এবং আত্মসমর্পণে আমেরিকান পতাকা নামাতে বাধ্য করে। কনফেডারেট যুক্তরাষ্ট্রের এই দুর্গকে নিজেদের বলে দাবি করে। ফলে এই ঘটনাটি গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। লিঙ্কন এই “বিদ্রোহ” দমন করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে, আরও চারটি ক্রীতদাস রাষ্ট্র কনফেডারেসিতে যোগ দেয়।
১৮৬১ সালের শেষের দিকে, ভার্জিনিয়া থেকে মিসৌরি পর্যন্ত প্রায় ১২০০ মাইল বিস্তৃত একটি পথ ধরে এক মিলিয়ন সশস্ত্র বাহিনী একে অপরের মুখোমুখি হয়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়; ভার্জিনিয়ার মানাসাস জংশনে , পশ্চিম ভার্জিনিয়ার পাহাড় ইত্যাদি স্থানে।
ফেডারেল বাহিনীর বিজয় পশ্চিম ভার্জিনিয়ার নতুন রাজ্য সৃষ্টির পথ সুগম করেছিল। মিসৌরির উইলসন ক্রিক, উত্তর ক্যারোলিনার কেপ হাটারাসে, এবং সাউথ ক্যারোলিনার পোর্ট রয়ালে কনফেডারেট বাহিনীর প্রবেশ বন্ধ করতে ফেডারেল বাহিনী একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। জুলাই ১৮৬১ সালের বুল রানের প্রথম যুদ্ধে, থমাস জোনাথন জ্যাকসন এর নেতৃত্বে ৩৫০০০ কনফেডারেট সৈন্য ওয়াশিংটন অভিমুখে বিশাল ফেডারেল বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ওয়াশিংটন ডিসি দ্রুত ফেডারেল বাহিনীর জন্য লিঙ্কনের কাছে আরো ৫০০,০০০ সৈন্য নিয়োগের জন্য আহ্বান করেন।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ একাধারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণেও সংগঠিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
অর্থনৈতিক কারণ
কটন বা তুলা অর্থনীতি
১৯ শতকে তুলার আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব। এটি বিশ শতকের শেষের দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের তেল শিল্পের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ১৭৯৩ সালে তুলার জিনের প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান ক্রীতদাস বাণিজ্যের কারণে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি বিশ্বের প্রধান তুলা সরবরাহকারী হয়ে ওঠে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, দক্ষিণাঞ্চল ব্রিটেনকে প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি তুলা রফতানি করছিল। সেই সময়ের পরাশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অর্থনীতি দক্ষিণাঞ্চল রাজ্যের তুলার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। কালো তুলার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ক্রীতদাসদের সাথে সাথে বাগানের মালিকরাও বিশাল সম্পদ এবং প্রভাব অর্জন করতে থাকে। ফলে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাগান মালিক যেকোনো সীমা পর্যন্ত যেতে রাজি ছিল। উত্তরে মুক্ত রাজ্য এবং দক্ষিণ দাস রাজ্যগুলির মধ্যে দীর্ঘ টানাপোড়ন এই সময়ে উত্তপ্ত অবস্থায় পৌছে যায়।
ক্রীতদাস
দক্ষিণ দাস রাজ্য এবং উত্তর মুক্ত রাজ্যের মধ্যে বহু দশক ধরে দাসত্ব নিয়ে বিরোধ ছিল। আটারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, উত্তর রাজ্যের বেশিরভাগ অংশে দাসপ্রথা অবৈধ ছিল। যাইহোক, দাসপ্রথা মূলত দক্ষিণ রাজ্যের অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিল, যা ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় শিল্পের কাঁচা তুলার প্রাথমিক উৎস হয়ে উঠেছিল।
গৃহযুদ্ধের শুরুতে, প্রায় ৪০ লক্ষ আফ্রিকান এবং তাদের বংশধররা দক্ষিণের দাস শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছিল। দক্ষিণাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদের মাথাপিছু সম্পদ ছিল উত্তরাঞ্চলের দ্বিগুণ। বিপরীতভাবে, দরিদ্র শ্রমিক শ্রেণী থাকা সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চল শিল্প ও উদ্যোক্তায় বেশি বিনিয়োগ করেছিল। উত্তরের রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহাওয়া ক্রমশ দাসপ্রথা বিরুদ্ধে চলে যায়।
রাজনৈতিক কারণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, আমেরিকায় নতুন নতুন অঞ্চল যুক্ত হওয়ায় দাসপ্রথার রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। প্রতিটি নতুন অঞ্চল একটি মুক্ত রাজ্য অথবা দাস রাজ্য হিসাবে যোগদান করেছ কিনা তা পর্যবেক্ষণ হচ্ছিল। উত্তরের শ্বেতাঙ্গরা আশঙ্কা করেছিল যে, যদি দাসপ্রথা নতুন অঞ্চলে বিস্তৃত হতে থাকে, তবে তারা দক্ষিণ দাস রাজ্যে যোগ দেবে, যা উত্তরকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে এবং দক্ষিণের প্রভাব বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে দক্ষিণরা দাসত্বকে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখেছিল। নতুন অঞ্চলে এর সম্প্রসারণ তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরও এগিয়ে নিতে সাহার্য করছিল।
ফেডারেল থেকে দক্ষিণের বিভাজন
লিঙ্কনের নির্বাচনে জয়ের পর, দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্য একটি রাজ্য সম্মেলন আহ্বান করে। ১৮ ডিসেম্বর ১৮৬০ সালে, তারা উত্তর থেকে বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ভোট দেয়। দক্ষিণের রাজ্যগুলি ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১ সালে, তাদের নিজস্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনে সম্মত হয়। এপ্রিল মাসে, ফোর্ট সাম্টারে কনফেডারেট আক্রমণের পর, লিঙ্কন সমস্ত রাজ্যগুলিকে পুনরায় দখলের জন্য বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানান।
সামাজিক কারণ
অ্যাবলনিস্ট মোভমেন্ট
১৮৫৮ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লিঙ্কন এবং স্টিফেন ডগলাস বিতর্ক ছিল নবগঠিত রিপাবলিকান পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে বিতর্কের একটি সিরিজ। এই বিতর্কের আলোচিত মূল বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্ব। এই বিতর্কগুলিই লিঙ্কনকে জাতীয় রাজনীতিতে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিণত করেছিল। তিনি ১৮৬০ সালে রাষ্ট্রপতির জন্য মনোনয়ন লাভ করেন, যা দক্ষিণপন্থীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। দক্ষিণপন্থীরা তার দাসত্ব বিরোধী অবস্থানের জন্য তাকে ঘৃণা করেছিল।
১৮৬০ সালের ৬ নভেম্বর, সবাইকে অবাক করে, আব্রাহাম লিংকন দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যের সমর্থন ছাড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যদিও তার নির্বাচন গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক কারণ নাও হতে পারে, তবে এটি দক্ষিণ রাজ্যগুলিতে সতর্কতার ঘণ্টা বাজিয়েছিল, যা বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়।