বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনী সমূহ

সংবিধানের সংশোধনী

সংবিধান হচ্ছে নাগরিক এবং রাষ্ট্রের আশা আকাঙ্ক্ষার তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রায়োগিক নির্দেশনা। বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্র সংবিধানের পরিবর্তন, সংযোজন, এবং বিয়োজন করে থাকে।
স্বাধীনতার পর বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনী আনা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান সর্বপ্রথম গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে এটি কার্যকর হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন হয়েছে সর্বমোট ১৭ বার। সর্বপ্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালে। তবে, কিছু সংশোধনী হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হয়েছে। এরমধ্যে, জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, হুসেইন মোহাম্মদ  এরশাদের সপ্তম সংশোধনী, এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী।
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংশোধনীর কথা বলা হয়েছে। যেমন, ১৪২ অনুচ্ছেদের ১ এর (ক): সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের মাধ্যমে সংশোধন করা যাবে।

সংবিধানের সংশোধনীসমূহ

প্রথম সংশোধনী
 
১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই, সংসদে সংবিধানের ১ম সংশোধনী গৃহীত হয়। ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করার মাধ্যমে এটি পাস হয়। এটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। এই সংশোধনীর মূল বিষয়বস্তু ছিল মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী এবং অন্যন্য গণবিরোধীদের বিচারের বিধান নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয় সংশোধনী
 
১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের ২য় সংশোধনী সংসদে গৃহীত হয়। ২২ সেপ্টেম্বর এটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। এটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। দ্বিতীয় সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাক্রমণ গোলযোগে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে সে অবস্থায় জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিধান। কারণ জরুরী অবস্থার সময় সংবিধানে নাগরিকের কিছু মৌলিক অধিকার বজায় থাকে না।
তৃতীয় সংশোধনী
এটি সংসদে প্রথম গৃহীত হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর। ২৭ নভেম্বর সংবিধানের ৩য় সয়শোধনী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। এটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। তৃতীয় সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বেরু বাড়িকে ভারতের নিকট হস্তান্তরের বিধান।
চতুর্থ সংশোধনী
 
বহুল আলোচিত সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংসদে গৃহীত হয়। একই দিনে অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারী এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। এটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসনের পরিবর্তে একক রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থা কায়েম এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি কায়েমের বিধান। জাতীয় সংসদের গুরুত্ব হ্রাস। আদালত কর্তৃক মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ক্ষমতা হরণ। রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি।
পঞ্চম সংশোধনী
 
১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল, সংসদে ৫ম সংশোধনী বিল গৃহীত হয়। পরের দিন এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। এটি সংসদে উত্থাপন করেন সংসদ সদস্য শাহ আজিজুর রহমান।পঞ্চম সংশোধনীর বিষয় ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে, সামরিক অভুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ফরমান ও প্রবিধানের বৈধতার বিধান। বাঙাালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তিন এবং সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সন্নিবেশন।
ষষ্ঠ সংশোধনী
এটি সংসদে গৃহীত হয় ৮ জুলাই, ১৯৮১ সালে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ৯ জুলাই। ষষ্ঠ সংশোধনীর মূল বিষয়বস্তু ছিল উপ রাষ্ট্রপতির পদে থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে বিধান।
সপ্তম সংশোধনী
সংসদে গৃহীত হয় ১০ নভেম্বর, ১৯৮৬ সালে। পরের দিন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। সপ্তম সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের পর থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসনে যেসকল আইন জারি করা হয়েছিল তার বৈধতা নিশ্চিত করার বিধান।
অষ্টম সংশোধনী
 
৭ জুন, ১৯৮৮ সালের এটি সংসদে গৃহীত হয়। ৯ জুন সংশোধনীটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান যোগ  করা হয়। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে রাস্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দান, ঢাকার বাহিরে হাইকোর্টের ৬ টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন। রাজধানীর নাম Dacca থেকে Dhaka, এবং Bangali থেকে Bangla করা হয়।
নবম সংশোধনী
গৃহীত হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ১১ জুলাই। নবম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি, একই সাথে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এছাড়াও উভয় পদের মেয়াদকাল ৫ বছর করা, এবং একজন সর্বোচ্চ ২ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবে।
দশম সংশোধনী
 
সংসদে গৃহীত হয় ১২ জুন, ১৯৯০। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে ২৩ জুন, ১৯৯০। দশম সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৩০ টি আসন ১০ বছরের সংরক্ষিত রাখা।
একাদশ সংশোধনী
গৃহীত হয় ৬ আগস্ট, ১৯৯১ সালে। ১০ আগস্ট রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ। সংশোধনীর বিষয় ছিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাব উদ্দিনের পূর্বপদে ফিরে যাবার বিধান।
দ্বাদশ সংশোধনী
 
সংসদে গৃহীত হয় ৬ আগস্ট, ১৯৯১। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯১।এটি সংসদে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।এই সংশোধনীর বিষয় ছিল বহু দিনের আকাঙ্ক্ষার সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তনের বিধান। উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রীর পদগুলো বিলুপ্ত করা।
ত্রয়োদশ সংশোধনী
এটি সংসদে গৃহীত হয় ২৭ মার্চ, ১৯৯৬। পরের দিন অর্থ্যাত ২৮ মার্চ, সংশোধনীটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ সংসদ  নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের বিধান।

চতুর্দশ সংশোধনী

১৬ মে, ২০০৪ সালের গৃহীত হয় এবং ১৭ মে এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে অনেকগুলো পরিবর্তন ও সংযোজন হয়েছে। এই সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল,
  • সংসদে ৪৫ টি নারী আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধান।
  • রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রির প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান। সংবিদানের ৪ (ক) নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রি ও স্পীকারের কার্যালয়, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস,সকল সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান,সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের কার্যালয় প্রভৃতি স্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রির প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হবে।
  • সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ: সংবিধানের ১৪৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার পরের তিন দিনের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্পীকার শপথ পাঠ করাতে ব্যর্থ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশন শপথ পাঠ করাবে।
  • বিচারপতিদের বয়স: সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিদের বয়স ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর নির্ধারন।
  • পিএসসি সদস্যদের বয়স: ১৩৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সরকারি কর্ম কমিশন বা পিএসসির চেয়ারম্যান ও এর সদস্যদের মেয়াদ ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ বছর করা হয়।
  • মহা হিসাব নিরীক্ষকের বয়স: সংবিধানের ১২৯ এর (১) নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে,  এ অনুচ্ছেদের বিধাননাপেক্ষে মহা হিসাব নিরীক্ষক তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের তারিখ থেকে ৫ বছর বা তাঁর ৬৫ টি বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকবে।

পঞ্চদশ সংশোধনী

গৃহীত হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। ৩ জুলাই, এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল,
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা।
  • সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা।
  • প্রধান নির্বাচন কমিশন সহ অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়েএকটি নির্বাচন কমিশন গঠন।
  • ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চার মূলনীতি(জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) পুনরায় স্থাপন।
  • রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল এবং সেই সাথে অন্যন্য ধর্মকে সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান।
  • সংবিধানের শুরুতে বিসল্লিাহির রাহমানির রাহিম এর সাথে পরম করণাময় সৃষ্টিকর্তার নামের সংযোজন।
  • বাংলাদেশি জনগণ জাতিতে বাঙালি এবং নাগরিকত্ব বাংলাদেশি বলে গণ্য হবে।
  • বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ঘোষণা ও ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানে  অন্তর্ভুক্ত।
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি।
  • জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৪৫ টি আসন থেকে ৫০ টি আসনে উন্নীত করা।
  • পঞ্চম, ষষ্ঠ, এবং সপ্তম তফসিল সংযোজন।
ষোড়শ সংশোধনী
 
সংসদে পাশ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে। ষোড়শ সংশোধনী উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এটির শিরোনাম ছিল এই আইন সংবিধান (ষোড়শ সংশোধনী) আইন, ২০১৪ নামে অভিহিত হবে। সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নতুনভাবে অনুচ্ছেদ ৯৬ প্রতিস্থাপিত হবে।
নতুন ৯৬ নং অনুচ্ছেদে বিচারকদের মেয়াদ,
  • বিচারকদের পদের মেয়াদ ৬৭ টি বছর বহাল থাকবে।
  • বিচারকদের প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারণ করা যাবে না।
  • কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রন করিবেন।
  • কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষর পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবে।
সপ্তদশ সংশোধনী
 
সংসদে গৃহীত হয় ৮ জুলাই, ২০১৮। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ২৯ জুলাই। সপ্তম সংশোধনী সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডবোকেট আনিসুল হক। এই সংশোধনীর বিষয় ছিল সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন আরো ২৫ বছর বাড়ানো।

Similar Posts