ভ্লাদিমির লেনিন কে ছিলেন?

ভ্লাদিমির লেনিন ছিলেন রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বলশেভিক বিপ্লবের নেতা এবং সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রথম প্রধান। তার শাসনের অধীনে রাশিয়ায় বৃহত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত একদলীয় সাম্যবাদী রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় তার পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লবে অত্যাচারী স্বৈরশাসক রোমানভ রাজবংশের সমাপ্তি এবং রাশিয়ায় শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে।

ভ্লাদিমির লেনিন

একজন রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবী এবং বলশেভিক পার্টির প্রধান। ২২ এপ্রিল, ১৮৭০ সালে, জার শাসিত রাশিয়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ভ্লাদিমির লেনিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। তিনি লেনিন নামে সর্বাধিক পরিচিত।লেনিনের পিতা ছিলেন ইলিয়া উলিয়ানোভ এবং মাতা মারিয়া আলেকজান্দ্রোভনা উলিয়ানোভার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
আদর্শগতভাবে তিনি সমাজতান্ত্রিক মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। লেনিনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাগুলো “লেনিনবাদ” নামে পরিচিত। লেনিনবাদ হল রাশিয়ান মার্কসবাদী বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিন কর্তৃক প্রচারিত একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। মরণোত্তর তার মতাদর্শ ‘‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’’ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
তিনি কাজান ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। অবৈধ ছাত্র বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে কাজান ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের পর, লেনিন জার্মান দার্শনিক এবং সমাজতন্ত্রবাদী কার্ল মার্ক্স এর উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ১৮৮৯ সালে, লেনিন নিজেকে মার্কসবাদী হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৮৯১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে সেখানেই আইন চর্চা শুরু করেন।
তিনি মার্কসবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে একবার গ্রেপ্তার হন। সাইবেরিয়ায় তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়। লেনিন সেখান থেকে জার্মান এবং তারপর সুইজারল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় মার্কসবাদীদের সাথে দেখা করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া

১৯১৪ সালের আগস্টে, মিত্রশক্তি জোটের সমর্থনে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। সামরিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার সাথে আধুনিক ও শিল্পোন্নত জার্মানির সাথে কোন মিল ছিল না। তাই যুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ ছিল একটি ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। যুদ্ধে রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি ছিল। এছাড়া খাদ্য ও জ্বালানির অভাব রাশিয়াকে শীঘ্রই বিশালভাবে জর্জরিত করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ে, লেনিন তার রাজনৈতিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। এই সময়েই তিনি সাম্রাজ্যবাদ, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম (১৯১৬) গ্রন্থটি লিখেন। যেখানে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল।
লেনিনের ক্ষমতা দখল
১৯১৭ সালের এপ্রিলে, রুশ বিপ্লব শুরু হয়। মার্চে খাদ্য ঘাটতির কারণে ধর্মঘট হলে জার নিকোলাস দ্বিতীয় পদত্যাগ করে। ফলস্বরুপ, রাশিয়ার শতাব্দীর সাম্রাজ্য শাসনের অবসান ঘটে। রুশ বিপ্লবের পর, রাশিয়া একটি অস্থায়ী সরকারের অধীনে আসে। যারা সামাজিক সংস্কারের বিরোধিতা করে এবং ১ম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখে। লেনিন অস্থায়ী সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র শুরু করেন। লেনিনের কাছে অস্থায়ী সরকার ছিল ‘‘বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব’’। তিনি শ্রমিক এবং কৃষকদের দ্বারা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব এর পরিবর্তে সরাসরি শাসনের পক্ষে সমর্থন করেছিলেন।
লেনিন নতুন সরকারের নেতৃত্বের শূন্যতাকে উপলক্ষ্য করে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি গোপনে কারখানার শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক এবং নাবিকদের স্বেচ্ছাসেবি রেডগার্ডসকে  আধাসামরিক বাহিনীতে রুপান্তরিত করেন। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে, রেড গার্ডস এক রক্তহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারি ভবন দখল করে।
বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে সোভিয়েত শাসনের ঘোষণা করে। লেনিন বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে সোভিয়েত সরকারের প্রধান হন। নতুন সোভিয়েত সরকার ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সম্পৃক্ততার অবসান ঘটায়।

বলশেভিক বিপ্লব

বলশেভিক বিপ্লবে রাশিয়া তিন বছরের এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। লেনিনের নবগঠিত রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত রেড আর্মি হোয়াইট আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে। হোয়াইট আর্মি ছিল রাজতন্ত্রবাদী, পুঁজিপতি এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের একটি জোট। এই সময়ে, লেনিন ‘‘যুদ্ধ কমিউনিজম’’ নামে একটি অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। ওয়ার কমিউনিজমের অধীনে, লেনিন দ্রুত সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে সমস্ত উত্পাদন এবং শিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি তার লাল সেনাবাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য কৃষকদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত শস্য আহরণ করেছিলেন।
লেনিনের এই ব্যবস্থাগুলো ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নতুন অর্থনীতির অধীনে শিল্প এবং কৃষি উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পায়। ১৯২১ সালে, আনুমানিক পাঁচ মিলিয়ন রাশিয়ান দুর্ভিক্ষে মারা যায় এবং রাশিয়া জুড়ে জীবনযাত্রার মানের পতন হতে শুরু করে। গৃহযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় ব্যাপক অর্থনীতির অবনতি হয়।
গণ অস্থিরতা সোভিয়েত সরকারকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় । ফলস্বরূপ, লেনিন তার নতুন আরেকটি অর্থনৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে বাজারমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে, যা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত ‘‘একটি মুক্ত বাজার’’ এবং‘‘ পুঁজিবাদ ব্যবস্থা।
বলশেভিক বিপ্লবের পর, লেনিন রাশিয়ায় প্রথম গোপন পুলিশ চেকা প্রতিষ্ঠা করেন। লেনিন তার নিজের রাজনৈতিক দলের মধ্যে তার বিরোধী এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের চুপ করার জন্য চেকা বাহিনী ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তার এই ব্যবস্থাগুলো আরো শত্রু বাড়াতে সাহার্য করে।
এরপর, লেনিন রেড টেরর প্রবর্তন করেন। রেড টেরর জার শাসক, রাশিয়ার উচ্চ শ্রেণী এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযান পরিচালনা করে। লেনিনের রেড আর্মি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। ১৯২২ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর, রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান এর সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (ইউএসএসআর) গঠন করে।
Union of Soviet Socialist Republics (USSR) গঠন
লেনিন নবগঠিত ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এর প্রধান হন। কিন্তু সেসময় তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ১৯২২ সালে, লেনিন স্ট্রোকের শিকার হন, যারফলে তার বাকশক্তি হারিয়ে যায়। ফলে তিনি শাসন ছেড়ে দেয়। লেনিনের অনুপস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্ট্যালিনের ক্ষমতার পথ সুগম হয়। কিন্তু লেনিন স্ট্যালিনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবে অসন্তুষ্ট হন এবং তার উত্থানকে ইউএসএসআর এর জন্য হুমকি মনে করেন।
লেনিন ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি, মস্কোর কাছে গোর্কি লেনিনস্কিয়েতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেনিনের সমাধি সুরক্ষার জন্য মস্কোর রেড স্কয়ার থেকে রাশিয়ার দূরবর্তী শহর টিউমেনে স্থানান্তর করা হয়।