রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের নবজাগরনের অগ্রদূত। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক আন্দোলনকারী, শিক্ষা সম্প্রসারক, এবং ধর্মসংস্কারক। রামমোহন একজন ধর্ম সংস্কারক হিসেবে অধিক সুনাম অর্জন করেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্য। সেই সময় হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বা আত্মহুতি দিতে বাধ্য করা হত। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
১৯ শতকে বাংলার মাটিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা- এসব ক্ষেত্রে যে যে পরিবর্তন এসেছে তার জন্য পুরো কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের। আজকে বাংলার সমাজ, উন্নত চিন্তাধারা এবং শিক্ষার দিক দিয়ে যে পরিবর্তনের দেখি, তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন রামমোহন রায়।
১৭৭২ সালের ২২ মে, হুগলি জেলার অন্তর্গত রাধানাথ গ্রামের এক তালুকদার বংশে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামকান্ত রায়, যিনি ছিলেন মোগল সরকারের একজন স্বল্প বেতনের রাজকর্মচারী এবং মাতা ছিলেন তারিণী দেবী। রামমোহনের পিতা রামকান্ত রায় ৩টি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী তারিণী দেবীর এক কন্যা ও দুই পুত্র ছিলো। পুত্র ২ জন হচ্ছে জগমোহন ও রামমোহন। রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। ১৮৩৩ সালে রামমোহন রায় ইংল্যান্ডের ব্রিষ্টল শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
অনেকের মতে, রামমোহন রায় ছোট বেলায় তাঁর নিজ বাড়িতে বা গ্রাম্য স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ফারসি ভাষা সে সময় রাজভাষা বিধায় তিনিও ছোটবেলায় ফারসি ভাষা শিখেন। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। বাংলা, আরবি, ফারসি, ইংরেজি এবং সংস্কৃতিতে ছিলেন অপরিসীম দক্ষ। পাটনায় গিয়ে আরবি ও ফারসি ভাষায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। সেখানে তিনি সুফি মতবাদে প্রভাবিত হন। যার ফলে, একই সাথে হিন্দু ও মুসলিম শাস্ত্রে পারদর্শী হন। পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্ক জ্ঞান লাভ করার জন্য তিব্বতে যান।
কর্মজীবন
বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী, ইংরেজ কালেক্টরের দেওয়ান, কোম্পানীর শেয়ারের ব্যবসায়ী, ধর্মশিক্ষা প্রচারক, এবং সমাজ সংস্কারক ইত্যাদি বহু কাজে জড়িত ছিলেন। রামমোহন রায় ২০ বছর বয়সে ইউরোপীয়দের সাথে মেলামেশা শুরু করেন। ফলস্বরুপ, তাদের যাবতীয় আইন-কানুন, রীতি-নীতি, এবং শাসন সংক্রান্ত ব্যবস্থার জ্ঞান লাভ করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত রামমোহন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ারুপে কর্মরত ছিলেন। ১৮০৫ সালে ইংরেজ কর্মকর্তা ডিগবির সাথে রামমোহনের পরিচয় হয় এবং তাঁর বানিয়া হিসেবে কাজ করেন।
তিনি ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ডিগবির সাথে বাংলার বিভিন্ন অংশে কাজ করেন। ডিগবির সাথে মালিক-কর্মচারি সম্পর্ক ছাড়াও ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তাঁর অধীনে থাকার ফলে রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষা এবং ইউরোপীয় রাজনীতির নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পাঠ করতেন। ১৮১৭ সালে তিনি যখন কলকাতায় আসেন, তখন তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিরুপ। কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকেই তিনি ধর্মসংস্কারের দিকে দৃষ্টিপাত করেন।
১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর, তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। তখন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করার ফলে, তিনি হিন্দুদের মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায় হিন্দুদের যাবতীয় আচরণীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মানতেন না এবং তা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতেন। হিন্দু সমাজে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতার কারণে বিশৃংখলা দেখা দিলে, রামমোহন রায় একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তার ধর্মসংস্কারের মুল কথা হচ্ছে হিন্দু সমাজে সকল প্রকারের কুসংস্কার দূর করা।
১৮০৩ সালে, তুহফত- উল-মুয়াহহেদিন বা একেশ্বরবাদ সৌরভ নামে আরবি ও ফারসি ভাষায় একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটিতে তিনি পৌত্তলিকতা ও বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। এবং সেই সাথে তাঁর একেশ্বরবাদি ধর্মের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
রামমোহন রায়ের মতে, ‘দেবদেবীতে বিশ্বাস ও তাদের প্রতিমা পুজা করা প্রকৃত হিন্দু ধর্মের বিরোধী’। একেশ্বরবাদি ধর্মের প্রচারের জন্য ১৮১৫ সালে, তিনি ‘আত্মীয় সভা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু, জমিদার কালিনাথ, নীলরতন হালদার এবং রামচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহনের এই ধর্মসংস্কারের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দুদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা রামমোহনের এসব সংস্কারের সমালোচনা করে বিভিন্ন পুস্তক রচনা করতে থাকে।
রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৮২৮ সালের ২০শে আগস্ট, তাঁর একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পুর্বের আত্মীয় সভাকে পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নামে নামকরণ করেন। এটি প্রতিষ্ঠায় রামমোহনের সাথে দ্বারকানাথ ঠাকুর যৌথ উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বেদান্ত ছিল তার ধর্ম সাধনার মূল ভিত্তি। প্রতি শনিবার সন্ধায় এই সভায় বেদ, উপনিষদ, বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা এবং সঙ্গীত পরিবেশিত হত।
১৮২১ সালে ‘Brahmunical Magazine‘ নামে ইংরেজিতে এবং ব্রাহ্মণসেবধি নামে বাংলায় পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি ফারসি ভাষায় ‘মিরাতুল আখবার’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদন করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায়ের অবদান অনেক বেশি। তিনি সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং দর্শন শিক্ষার গুরুত্ব আরোপ করতেন।
তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য সর্বপ্রথম ১৮২১ সালে সংবাদ কৌমুদি নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা, সংস্কৃতি, আরবী, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
তাঁর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহ হলো, বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্ত সার (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), প্রবর্তক ও নিবর্তকের সস্বাদ (১৮১৯), পথ্যপ্রদান (১৮২৩), গৌড়ীয় ব্যাকরণ,