রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

রাষ্ট্র হল এমন এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস এর মতে, ‘‘একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিই হল রাষ্ট্র।’’
অধ্যাপক গার্নারের মতে, ‘‘রাষ্ট্র হল সাধারণভাবে বৃহৎ এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার রয়েছে এবং এই সরকারের প্রতি অধিকাংশ জনগণ স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে।
ওপেনহাইমে এর মতে, ‘‘যখন কোনাে নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে কোনাে সংগঠিত জনসমষ্টি সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠা করে, তখন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।’’
মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের মতে, ‘‘কোনাে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত জনসমষ্টি হল রাষ্ট্র।’’

রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান

রাষ্ট্র চারটি প্রধান উপাদান নিয়ে গঠিত। যথা: জনসংখ্যা, ভূখন্ড বা অঞ্চল, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব।
1. জনসংখ্যা (Population)
রাষ্ট্র হল মানুষের একটি মানবিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে জনসংখ্যা। জনসংখ্যা ছাড়া রাষ্ট্র হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। যেমন সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর এর  মতো খুব ছোট জনসংখ্যার রাষ্ট্র। অন্যদিকে রয়েছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার যেখানে খুব বেশি জনসংখ্যা রয়েছে।
রাষ্ট্রে বসবাসকারী লোকদের নাগরিক বলে। নাগরিকরা রাষ্ট্রের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। অন্য দেশের নাগরিকরা বসবাস করলে তখন তাদের বলা হয় বিদেশি। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল ব্যক্তি, নাগরিক এবং সেইসাথে বিদেশিদের রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতি মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্র তার সরকারের মাধ্যমে তাদের উপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে।
2. অঞ্চল (Territory)
ভূখণ্ড একটি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য উপাদান। রাষ্ট্র একটি আঞ্চলিক ইউনিট। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হল এর অপরিহার্য উপাদান। একটি রাষ্ট্র কখনো আকাশে বা সমুদ্রে থাকতে পারে না। এর পিজিকাল অংশ (অঞ্চল) নিয়ে গঠিত হয়। এটি মূলত একটি আঞ্চলিক রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের আকার বড় বা ছোট হতে পারে।
রাশিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, ব্রাজিল ইত্যাদি বড় আকারের রাষ্ট্র। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ড, বুরুন্ডি ইত্যাদি ছোট অঞ্চল রাষ্ট্র। সমগ্র ভূখণ্ড রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধীনে বেষ্টিত। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত ব্যক্তি, সংস্থা, সমিতি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি অঞ্চলের সার্বভৌম এখতিয়ারের অধীনে।
রাষ্ট্রের অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্র বা কিছু দ্বীপও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আন্দামান ও নিকোবর ভারতের অংশ। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের অংশ। রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের সমস্ত অংশের উপর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করে।
3. সরকার (Government)
সরকার হল রাষ্ট্রের অন্যতম সংস্থা বা ম্যাজিস্ট্রেসি যা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ, এবং বিচার করে। সরকার রাষ্ট্রের তৃতীয় অপরিহার্য উপাদান। রাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
অনেকেই মনে করে যে রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। যাইহোক, এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত যে সরকার রাষ্ট্রের একটি উপাদান মাত্র। এটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
তিনটি প্রধান অঙ্গ নিয়ে একটি সরকার গঠিত হয়। যেমন:
(1) আইনসভা (Legislature): যা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের কার্য সম্পাদন করে। স্পিকার, প্রধানমন্ত্রি ও বিভিন্ন মন্ত্রি, সাংসদ নিয়ে আইনসভা গঠিত।
(২) নির্বাহী বিভাগ (Executive): রাষ্ট্রের আইন-প্রয়োগের কার্য সম্পাদন করে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান হল প্রধানমন্ত্রি, কিছু দেশে রাষ্ট্রপতি বা অন্য কেউ হতে পারে।
(3) বিচার বিভাগ (Judiciary): আইনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বিচার কার্য সম্পাদন করে। রাষ্ট্রের আইনের ধারক বাহক হচ্ছে এই বিচার বিভাগ।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের সরকার বিদ্যামান রয়েছে। যেমন;
  • গণতান্ত্রিক সরকার,
  • সমাজতান্ত্রিক সরকার,
  • এককেন্দ্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার,
  • একনায়কতান্ত্রিক সরকার
  • রাজতান্ত্রিক সরকার
  • রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার
4. সার্বভৌমত্ব (Soveirgnity)
সার্বভৌমত্ব একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ একমাত্র রাষ্ট্রই সার্বভৌমত্বের অধিকারী। সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোনো রাষ্ট্র কল্পনা কার যায় না। প্রকৃতপক্ষে, সার্বভৌমত্ব হল সেই ভিত্তি যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের জীবনের সমস্ত দিক নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা প্রদান করে।
সার্বভৌমত্ব দুধরনের;
(i) অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব: অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এর চরম ক্ষমতাকে বােঝায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনাে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকার নিজেও রাষ্ট্রীয় আইনের উর্ধ্বে নয়।
(ii) বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব: রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বলতে বােঝায় যে, বহিঃশক্তির সকল রকমের আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্র মুক্ত, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কারণে কোনাে স্বাধীন রাষ্ট্র বিদেশি রাষ্ট্রের নির্দেশে পরিচালিত হয় না।

Similar Posts