ফরায়েজি আন্দোলন কি? ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস

ফরায়েজি আন্দোলন কি

উনিশ শতকে ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি জমিদার, এবং নীলকরদের অত্যাচার-শোষণ, থেকে কৃষকদের মুক্ত করার আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিলে হাজী শরীয়তুল্লাহ এর নেতৃত্ব দেন। তাঁর এ-আন্দোলনকে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ বলে।
ফরায়েজী’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ফরজ’ (অবশ্য পালনীয়) থেকে। যদিও, পরবর্তীতে এ-আন্দোলনে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সংস্কারের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পায়। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘ধর্মীয় অবশ্য পালনীয় বিধানবলীর বাস্তবায়ন’। অর্থাৎ ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোর পালন ও অনুসরণ করা।
ফরায়েজি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে ধর্মীয় আন্দোলনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত আন্দোলন। বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় বিপর্যয় ঘটে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের আহ্বান করেন। একই সঙ্গে তিনি ‘শিরক’ ও ‘বিদাত’ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, চাকরি, জমিদারি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার মুসলমানদের আত্ম-সচেতনতা তৈরি ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ঠিকমতো পালন করানোর লক্ষ্যে হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যহত ছিল।

ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস

ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা হাজী শরীয়ত উল্ল্যাহ বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার শাসশাইল গ্রামে ১৭৮২ খ্রিস্ট্রাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে, হাজী শরীয়ত উল্ল্যাহ মাওলানা বাসারাত আলীর সঙ্গে মক্কা গমন করেন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন।
পরবর্তীতে, কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হন। এইভাবে প্রায় কুড়ি বছর তিনি বিদেশে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও আইন সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে  স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফেরার পর, তিনি উপলব্ধি করেন যে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ইসলামবিরোধী কুসংস্কার ও অপসংষ্কৃতি অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
ইসলাম ধর্মকে কুসংস্কার ও অনৈসলামিক অনাচারমুক্ত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এই প্রতিজ্ঞার বশবর্তী হয়ে, তিনি উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনই ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ নামে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে।
তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানরা ইসলামের ফরজ বিধানগুলো ঠিকমতো পালন না করলে তাদের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হবে না। মুসলমানদের ইমানি শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া ব্রিটিশদের বিভিন্ন অন্যায়-অপশাসনের প্রতিবাদ করা যাবে না। তিনি বাংলার কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন।
প্রথম দিকে ফরিদপুরকেন্দ্রিক ফরায়েজি আন্দোলন শুরু হলেও ক্রমে তা আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় সংস্কারের পাশপাশি কৃষকদের জমিদার, নীলকরদের অত্যাচার ও শোষন হতে মুক্ত করা ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ কৃষকদের অবৈধ কর দেয়া থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন এবং জমিদারদের সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান করেন। এর ফলে, ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে, হাজী শরীয়ত উল্লাহর উপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তিনি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর, তাঁর ছেলে মুহম্মদ মুহসিন উদ্দীন আহমদ বা দুদু মিয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দুদু মিয়া ছিল তার ডাকনাম
দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন একাধারে একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক শ্রেণির শোষণ মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। যার ফলে, এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইংরেজ শাসকদের চরম অর্থনৈতিক শোষণে বিপর্যস্ত বাংলার কৃষক এই আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণবিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। কৃষকরা জমিদার, ও নীলকরদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ফরায়েজি আন্দোলনে যোগদান করে।
ফরায়েজিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে দৃঢ় এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দুদু মিয়া নিজে লাঠি চালনা শিক্ষা নেন। দুদু মিয়া তাঁর পিতার আমলের লাঠিয়াল জালালউদ্দিন মোল্লাকে সেনাপতি নিয়োগ করে এক সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের অবৈধ কর আরোপ এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।
দুদু মিয়া তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জমিদার, নীলকর এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম চালিয়ে যান। কিন্তু দেশীয় জমিদাররা ইংরেজ শাসক ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা বা সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে ইংরেজ সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে।
ভীত ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কলকাতার কারাগারে আটকে রাখেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে, তিনি মুক্তি পান এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এই দেশ প্রেমিক দুঃসাহসী বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।

Similar Posts