‘ওয়াহাবি’ শব্দটি আরবের সংস্কারক মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের নাম থেকে এসেছে। ওয়াহাবি শব্দটির অর্থ হল নবজাগরণ (Renaissance)। ওয়াহাবি আন্দোলনের আসল নাম ছিল তারিখ-ই-মুহাম্মদিয়া (বা মুহাম্মদ নির্দেশিত পথ)।
অষ্টাদশ শতকে, মহম্মদ-বিন-আবদুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি আরবে ইসলাম ধর্মের কুসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম এক আন্দোলন গড়ে তােলেন। তাকে অনুসরণ করে, উনিশ শতকের সূচনালগ্নে দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটান।
ওহাবী (وهابى) শব্দটি আরবী, এটি আল্লাহতালা’র সিফাতি নামগুলোর অন্যতম। আক্ষরিক অর্থে ওয়াহাবী বা ওহাবী মানে ‘আল্লাহওয়ালা’। তবে, ঐতিহাসিকভাবে ‘ওহাবী’ বলতে মূলত সৌদি আরবের প্রখ্যাত শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব এর ‘মুহাম্মদী আন্দোলন’ এর সাথে জড়িত কিংবা তার মতের অনুসারীদের বুঝানো হয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত অন্যতম ইসলামিক আন্দোলন ছিল ওয়াহাবি আন্দোলন। সংখ্যালঘু মুসলিমদের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন পরিচালিত হলেও ধীরে ধীরে সমাজের নিম্নবর্গের হিন্দুরাও এই বিদ্রোহে যােগ দিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। অনেকের মতে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন ।
অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব মধ্য এশিয়ার মূলত আরবে ইসলামের পুনুরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। অ-মুসলিমীয় রীতিনীতি পরিত্যাগ করে কোরানের নির্দেশ মতো ইসলামীয় অনুশাসন অনুযায়ী ধর্ম ও সমাজকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তোলাই ছিল এই ওয়াহাবিবাদের(Wahhabism) মূল উদ্দেশ্য ।
ভারতে ওহাবী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লীর শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তার পুত্র আব্দুল আজিজ। উত্তর প্রদেশের সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভি মক্কায় হজ করতে গিয়ে আবদুল ওয়াহাবের সংস্পর্শে আসেন। মূলত তার হাত ধরে ভারতে ওয়াহাবি অন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিলো। সৈয়দ আহমদ ঘোষণা করেন ভারত একটি ‘দার-উল-হারব’ বাঁ শত্রু রাষ্টে পরিণত হয়েছে। একে দার-উল-ইসলাম বা ধর্মরাজ্যে পরিণত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি শুধুমাত্র ইংরেজ নন শিখদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কুচকাওয়াজ ও সামরিক শিক্ষার ওপর জোর দেন। শিখরা পেশোয়ার পুনরাধিকার করার পর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শিখদের সঙ্গে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ পরাজিত ও নিহত হন ।
সৈয়দ আহমদ মৃত্যুর পর তার দুই শিষ্য উলায়ৎ আলি এবং এনায়েত আলি ওয়াহাবি আদর্শ প্রচার করেছিলেন। দিল্লী, মিরাট, বিহার ও বাংলায় ওয়াহাবিরা যথেষ্ট তৎপর ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ওয়াহাবিরা বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগদান করেছিল।
প্রথম দিকে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ। ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণত হয়। সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ওয়াহাবিগণ দ্রুত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য তাঁরা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবিগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার জয় করেন। কিন্তু তাদের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ প্রাণ হারান এবং ওয়াহাবিরা পরাস্ত হন। পাঞ্জাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার ওয়াহাবিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ক্রমশ বাংলা, বিহার, মীরাট ও হায়দরাবাদে ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তারলাভ করে ।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি ওরপে তিতুমির। তিতুমিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রাম বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়। তিনি কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করেন। সেখানে তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে দেশে ফিরে, তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন।
তিতুমিরকে দমনের জন্য গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান। তিতুমীরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । তিতুমীর তাঁর ৬০০ অনুগামী কাঁচা বেল, ইট, তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের উপর আঘাত হানে । ইংরেজ সেনাবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায়। ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করেন। শেষ পর্যন্ত, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে, সংঘর্ষে তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন। তিতুমির ও তাঁর অনুসারিদের মৃত্যুর পর, বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটে।