মার্কসবাদ কি
মার্কসবাদ হল কার্ল মার্কসের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন। অর্থাৎ কার্ল মার্কস দ্বারা উদ্ভূত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা দর্শন যা পুঁজিবাদী এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রামের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, তাকে মার্কসবাদ বলে ।
সহজ ভাষায় মার্কসবাদ, এটি একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তত্ত্ব যেখানে সমাজের কোন শ্রেণী নেই। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি সাধারণ মঙ্গলের জন্য কাজ করে, এবং তাত্ত্বিকভাবে যেখানে কোন শ্রেণী সংগ্রাম নেই।
মার্কসবাদ জার্মান দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্সের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত হয়। কার্ল মার্ক্সের বন্ধু এবং সহযোগী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস মার্কসবাদী চিন্তাধারায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের রেখেছিল।
মার্কসবাদের উৎস
১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কর্তৃক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) নামক পুস্তিকাতে মার্কসবাদের তত্ত্ব প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটিতে শ্রেণী সংগ্রাম এবং বিপ্লবের তত্ত্বকে তুলে ধরা হয়। মার্কসীয় অর্থনীতি পুঁজিবাদের সমালোচনার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যা ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত কার্ল মার্কস এর বই দাস ক্যাপিটালে (Das Capital) লিখেছিলেন।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, মার্কসবাদ পশ্চিম ইউরোপে শ্রম ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উপাদান সমূহকে দৃঢ়, এবং অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য কর এবং এটি পরবর্তীতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং মাওবাদের ভিত্তি স্বরুপ হয়, যা রাশিয়ায় ভ্লাদিমির লেনিন এবং মাও সেতুং চীনে বিকাশিত বিপ্লবী মতবাদ। এছাড়াও মার্কসবাদের দুটি প্রধান উৎস রয়েছে যেমন, ঐতিহাসিক উৎস এবং তত্ত্বগত উৎস।
ফরাসি বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের ফলে, ইউরোপের আধুনিক শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে এবং শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন মার্কসবাদের অন্যতম উৎস।
মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য
এটি শ্রম, উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর পুঁজিবাদের প্রভাব পরীক্ষা করে এবং কমিউনিজমের পক্ষে, এবং শ্রমিক বিপ্লবের পক্ষে যুক্তি দেয়।
মার্কসবাদ হল এমন একটি ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব যেখানে ধনী শ্রেণী এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এটি একটি দর্শন বা কার্ল মার্ক্সের একটি আদর্শ যেখানে সকল মানুষ সমান এবং সম্মানিত।
মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে পুঁজিবাদী এবং শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক শোষণমূলক এবং অনিবার্যভাবে শ্রেণী সংঘাতের সৃষ্টি করবে। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে এই দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত একটি বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাবে, যেখানে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী শ্রেণীকে উৎখাত করবে এবং পরিপূর্ণভাবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ দখল করবে।
মার্কসবাদের তত্ত্বের উপাদান
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রেণী দ্বন্দ্ব কীভাবে কার্যকর হবে সে সম্পর্কে মার্কসের তত্ত্বের উপাদানগুলো নিম্নরূপ।
- পুঁজিবাদী সমাজ দুটি শ্রেণী নিয়ে গঠিত: বুর্জোয়া বা ব্যবসায়ী মালিক, যারা উৎপাদনের উপায় নিয়ন্ত্রণ করে এবং সর্বহারা বা শ্রমিক, যাদের শ্রমের মাধ্যমে কাঁচা পণ্যকে মূল্যবান অর্থনৈতিক পণ্যে রূপান্তরিত করে।
- সাধারণ শ্রমিক, যারা উৎপাদনের উপায় যেমন কারখানা, ভবন এবং উপকরণের মালিক নয়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের ক্ষমতা কম। উচ্চ বেকারত্বের সময়েও শ্রমিকরা সহজেই প্রতিস্থাপনযোগ্য, এবং তাদের অনুভূত মূল্যকে আরও অবমূল্যায়ন করা হয়।
- মুনাফা বাড়ানোর জন্য, মালিকরা শ্রমজীবীদের থেকে সর্বাধিক কাজ পাওয়ার জন্য একটি প্রণোদনা দেয় কিন্তু তাদের সর্বনিম্ন মজুরি প্রদান করে। এটি মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে একটি অন্যায্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, এবং মালিকরা নিজেদের লাভের জন্য শ্রমিকদের শোষণ করতে থাকে।
- যেহেতু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের ব্যক্তিগত অংশীদারিত্ব খুব কম, মার্কস বিশ্বাস করেছিলেন যে, শ্রমিকরা এটি থেকে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং মালিকদের প্রতি বিরক্ত হবে।
- বুর্জোয়ারা তাদের ক্ষমতা এবং অবস্থান বজায় রাখতে সরকার, মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, ব্যাঙ্কিং এবং আর্থিক ব্যবস্থা সহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বহারা শ্রেণীর বিরুদ্ধে হাতিয়ার এবং অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করে।
- শেষ পর্যন্ত, এই দুই শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্নিহিত অসমতা এবং শোষণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করবে যেখানে শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, উৎপাদনের উপায়গুলো নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পুঁজিবাদকে বিলুপ্ত করবে।