পানিপথের যুদ্ধ : কারণ ও ফলাফল

পানিপথের যুদ্ধ

ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ নামক স্থানে তিনটি বিখ্যাত যুদ্ধ (১৫২৬, ১৫৫৬, ১৭৬১) সংগঠিত হয়েছিল, যে যুদ্ধগুলো ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ নামে পরিচিত। পানিপথের প্রথম যুদ্ধটি সংগঠিত হয়েছিল ১৫২৬ সালে, মুঘল সম্রাট বাবর ও দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীর মধ্যে। মুঘলরা এ যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ১৫৫৬ সালে, মুঘল সম্রাট আকবর এবং সম্রাট হেম চন্দ্র বিক্রমাদিত্যর সঙ্গে। যুদ্ধে মুঘলদের বিজয় হয়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছিল আফগানিস্তানের অধিপতি আহমদ শাহ দুররানি (আহমদ শাহ আবদালী নামেও পরিচিত) ও মারাঠাদের অধিপতি বালাজি বাজি রাও-এর মধ্যে। এ যুদ্ধে আহমদ শাহ আবদালীর বাহিনী মারাঠাদের পরাজিত করেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (১৫২৬)
১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল, লোদি সাম্রাজ্যের ইব্রাহিম লোদি এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মধ্যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উত্তর ভারতে হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ গ্রামের নিকটে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও ছিল গানপাউডার আগ্নেয়াস্ত্র এবং ফিল্ড আর্টিলারির মত আগ্নেয়াস্ত্র।
বাবরের বাহিনীতে ১৫,০০০ সৈনিক এবং ২০ থেকে ২৪টি ফিল্ড আর্টি‌লারি ছিল। ইবরাহিম লোদির বাহিনীতে সর্বমোট লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১,০০,০০০। এর পাশাপাশি হাতি ছিল প্রায় ১,০০০ এর মত। বাবরের বাহিনী তাদের মাস্কেট, কামান ও ঘোড়সওয়ারদের নিয়ে আক্রমণ শুরু করলে, ইবরাহিম লোদি পরাজিত ও নিহত হন।
বাবরের কামান-বন্দুক যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ে ভূমিকা রেখেছে। কামানের বিকট শব্দ লোদি বাহিনীর হাতিগুলোকে ভয় পাইয়ে দেয়, ফলে হাতিগুলো লোদি বাহিনীর সেনাদের পদদলিত করা শুরু করে। যুদ্ধে ইবরাহিম লোদি তার ১৫,০০০ সৈনিকসহ নিহত হন।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৫৫৬)

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ উত্তর ভারতের হিন্দু রাজা সম্রাট হেম চন্দ্র বিক্রমাদিত্যের বাহিনী এবং আকবরের সেনাবাহিনীর মধ্যে ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সালে সংঘটিত হয়েছিল। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আকবর। সম্রাট আকবরের সঙ্গে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের সাথে। বৈরাম খাঁ সম্রাট আকবরের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
পটভূমি
মূঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ূন ১৫৪০ সালে শের শাহের নিকট রাজত্ব হারিয়েছিলেন। ১৫৪৫ সালে শের শাহের মৃত্যু হলে উত্তরসূরী হয় তাঁর ছোট ছেলে ইসলাম শাহ সূরি। কিন্তু ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহ সূরির মৃত্যুর পর, সূর সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রদেশসমূহে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এমতাবস্থায়, হুমায়ুন হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে এই বিদ্রোহ কাজে লাগান এবং ১৫৫৫ সালের ২৩শে জুলাই, মুঘলরা সিকান্দার শাহ সুরি কে পরাজিত করে, এবং সবশেষে দিল্লী ও আগ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
হেম চন্দ্র ছিল আদিল শাহর প্রধানমন্ত্রী এবং সূরি সেনাবাহিনীর জেনারেল। ১৫৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি, হুমায়ুনের মৃত্যুর সময়, হেম চন্দ্র বাংলায় ছিলেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যু মুঘলদের পরাজিত করার ও হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার আদর্শ সুযোগ করে দিয়েছিল।
হেমু বাংলা থেকে দিল্লীতে দ্রুত যাত্রা করে এবং মুঘলদের  বায়ানা, ইতাহা, সাম্ভাল, কালপি এবং নারাউল থেকে তাড়িয়ে দেন। আগ্রাতে হেমুর আসন্ন হামলার সংবাদ পেয়ে যুদ্ধ না করে প্রশাসক পালিয়ে যায়। প্রশাসকের পিছু ধাওয়া করে হেমু দিল্লীর বাইরে তুঘলাকাবাদে পৌছে যান, যেখানে তিনি মুঘল প্রশাসক তারদি বেগ খানের সেনাবাহিনীর দেখা পান এবং তুঘলাকাবাদের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। ১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধের পর, হেমু দিল্লী দখল করে এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। যুদ্ধে প্রায় ৩,০০০ মুঘল নিহত হয় এবং ৩৫০ বছর মুসলিম শাসনের পর উত্তর ভারতে হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ (১৭৬১)

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছিল আফগানিস্তানের অধিপতি আহমদ শাহ দুররানি (আহমদ শাহ আবদালী নামেও পরিচিত) ও মারাঠাদের অধিপতি বালাজি বাজি রাও-এর মধ্যে। এ যুদ্ধে আহমদ শাহ আবদালী মারাঠাদের পরাজিত করেন।
১৭৬১ সালের ১৪ জানুয়ারী, দিল্লি থেকে প্রায় ৬০ মাইল উত্তরে পানিপথ নামক স্থানে মারাঠা বাহিনী এবং আফগানিস্তানের রাজা আহমেদ শাহ দুররানির দুই ভারতীয় মুসলমানের জোটের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধকে ১৮ শতকের বৃহত্তম যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং উভয় সেনাবাহিনীর এক দিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
পটভূমি
২৭ বছরের মুঘল-মারাঠা যুদ্ধের (১৬৮০-১৭০৭) পরে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন মারাঠাদের সাম্রাজ্য লাভের দিকে পরিচালিত করেছিল। পেশওয়া বাজি রাওয়ের অধীনে গুজরাট ও মালওয়া মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। অবশেষে, ১৭৩৭ সালে, বাজি রাও দিল্লির উপকণ্ঠে মুঘলদের পরাজিত করেন এবং দিল্লির দক্ষিণে মুঘল অঞ্চলগুলোকে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। বাজি রাও-এর ছেলে, বালাজি বাজি রাও, ১৭৫৮ সালে পাঞ্জাব আক্রমণ করে মারাঠা নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে পরিণত করে।
এটি আহমদ শাহ আবদালির দুররানি সাম্রাজ্যের সাথে মারাঠাদের সরাসরি সংঘর্ষে নিয়ে আসে। ১৭৫৯ সালে আহমদ শাহ আবদালি পশতুন উপজাতিদের থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং পাঞ্জাবের ছোট মারাঠা গ্যারিসনগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণ করে জয় লাভ করেন। তারপর, তিনি তার ভারতীয় মিত্রদের সাথে যোগ দেন। সদাশিবরাও ভাউ-এর অধীনে মারাঠারা ৪৫,০০০-৬০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে এর প্রতিক্রিয়া জানায়।
১৪ই মার্চ ১৭৬০ সালে, মারাঠা এবং দুররানি সাম্রাজ্যে উভয়ই নবাব সুজা-উদ-দৌলাকে তাদের শিবিরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। জুলাইয়ের শেষের দিকে, সুজা-উদ-দৌলা আফগান-রোহিল্লা জোটে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। এটি মারাঠাদের জন্য কৌশলগতভাবে একটি বড় ক্ষতি ছিল কারণ সুজা-উদ-দৌলা উত্তর ভারতে দীর্ঘ আফগান শাসনে থাকায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করেছিলেন। সুজা-উদ-দৌলা সমর্থন ছাড়া মারাঠাদের সাথে বিরোধ চালিয়ে যাওয়ার উপায় আফগান-রোহিলা জোটের ছিল না। অবশেষে ১৭৬০ সালের আগস্ট, দিল্লিতে পৌঁছে এবং পরের দিন শহরটি দখল করে।

Similar Posts