আফিম যুদ্ধ : কারণ ও ফলাফল | প্রথম আফিম যুদ্ধ | দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ

আফিম যুদ্ধের ইতিহাস

আফিম যুদ্ধ (Opium Wars) হল ১৯ শতকের মাঝামাঝি চীনে পশ্চিমা দেশগুলোর বাহিনী এবং কিং রাজবংশের (Qing Dunasty) মধ্যে দুটি সশস্ত্র সংঘর্ষ। প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২) চীন এবং ব্রিটেনের মধ্যে সংঘটিত হয় এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৫৬-৬০), ব্রিটেন এবং ফ্রান্স চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ তীর যুদ্ধ বা চীনে অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
উভয় যুদ্ধে বিদেশী শক্তিগুলো বিজয়ী হয় এবং চীনে বাণিজ্যিক সুবিধা, আইনি ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ছাড় পায়। আফিম যুদ্ধে চীনের সার্বভৌমত্বের উপর অসম চুক্তির প্রয়োগ এবং ছাড়ের কারণে, ২০ শতকের গোড়ার দিকে প্রজাতন্ত্রী চীনে রাজবংশ দুর্বল এবং শেষ পর্যন্ত পতন ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
১৮৩৯ সালে, গ্রেট ব্রিটেন এবং চীনের মধ্যে আফিমকে কেন্দ্র করে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়, ইতিহাসে তা প্রথম আফিম যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত তিন বছরব্যাপী প্রথম আফিম যুদ্ধ স্থায়ী ছিল।

আফিম যুদ্ধের কারণ

উনবিংশ শতাব্দির আগে, চীন ছিল একটি বিচ্ছিন্ন দেশ। তখন এটি বিশ্বের কাছে একদম অপরিচিত একটি দেশ ছিল। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, চীন বৈদেশিক বাণিজ্যের পথ বন্ধ করে তাদের অভ্যন্তরীণভাবে বিকাশ সাধন করেছিল।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে, যখন পশ্চিমা বণিকরা ধীরে ধীরে চীনের সাথে বাণিজ্য শুরু করে, তখন এই সব পরিবর্তন হতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে, গ্রেট ব্রিটেনের মতো ইউরোপীয় অন্যন্য দেশগুলো চীনা রাজবংশ শাসিত সরকারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ইন-রোড তৈরি করেছিল এবং ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল যে, চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হওয়ার মত দেশ।
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে, গ্রেট ব্রিটেন চীনে আফিম রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল। আফিম, একটি অত্যন্ত আসক্তিযুক্ত মাদক, যা ভারতে জন্মানো পপি গাছ থেকে তৈরি করা হয়। আর ব্রিটেনের উপনিবেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। ব্রিটেন ভারত থেকে আফিম চীনে রফতানি করতে শুরু করে। চীনা ক্রেতারা আফিম মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে, আফিমের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যায়।
আফিমের ব্যাপক আসক্তি চীনা জনগণের জন্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক ছিল। এতে চীনা সরকার ব্রিটিশদের উপর অসন্তুষ্ট হয়। ফলস্বরুপ, চীন আফিম ব্যবসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং সেইসাথে ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের দেশে আসতে নিষেধ করে।
নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, ব্রিটিশরা অবৈধভাবে চীনে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৮৩৯ সালের মার্চ মাসে, চীনা সরকার প্রায় ১৪০০ টন আফিম ধ্বংস করার পদক্ষেপ নেয়। এই ধ্বংসকৃত মাদকের দাম প্রায় ২.৮ মিলিয়ন পাউন্ড।
এর ফলে, ব্রিটিশ বণিক ও চীনাদের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এমনাবস্থায়, ব্রিটিশ নাবিকদের একটি দল একজন চীনা ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলে। কিন্তু হত্যার পর ব্রিটিশ সরকার তার অভিযুক্ত নাগরিকদের চীনের কাছে হস্তান্তর করবে না বলে ঘোষণা দেয়। এটি চীন সরকারকে আরও ক্ষুব্ধ করেছিল।

প্রথম আফিম যুদ্ধ

১৮৩৯ সালে, গ্রেট ব্রিটেন এবং চীনের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তিন বছরব্যাপী প্রথম আফিম যুদ্ধ শুরু হয়। চীনা সরকার বিপুল পরিমাণ আফিম ধ্বংস করে। ফলস্বরুপ, ব্রিটিশ বাহিনী পার্ল নদীতে ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে রাখা চীনা অবরোধ ধ্বংস করে।
১৮৪০ সালে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর একটি বিচ্ছিন্ন দল হংকং থেকে পার্ল নদীর উপর দিয়ে ক্যান্টন বন্দরে চলে যায়। দুই দেশ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার পর, ব্রিটিশরা ১৮৪১ সালের মে মাসে, তারা ক্যান্টন দখল করে।
এক বছর পর, ১৮৪২ সালে তারা নানকিং শহরও দখল করে। এই মুহুর্তে, চীনারা বুঝতে পেরেছিল যে, তারা গ্রেট ব্রিটেনের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, ফলে চীনা সরকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
১৮৪২ সালের ২৯শে আগস্ট, নানকিং চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।

দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ

১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন কিং (Qing) সরকার তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫০-৬৪) দমন করার চেষ্টায় জড়িয়ে পড়েছিল, তখন ব্রিটিশরা চীনে তাদের বাণিজ্য অধিকার প্রসারিত করতে মনোবিষণ শুরু করে। এর জন্য ব্রিটিশরা শত্রুতা পুনর্নবীকরণের জন্য একটি অজুহাত খুঁজতে থাকে।
১৮৫৬ সালের অক্টোবরের শুরুতে, কিছু চীনা কর্মকর্তা ব্রিটিশ-নিবন্ধিত জাহাজ অ্যারোতে চড়েছিলেন, যখন এটি ক্যান্টনে ডক করা ছিল, তখন বেশ কয়েকজন চীনা সদস্যকে গ্রেপ্তার করে (যাদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল)। গ্রেফতারের কারণ হিসেবে তারা অভিযোগ করেন যে, চীনা সদস্যরা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দিয়েছিল।
অক্টোবরের শেষের দিকে, একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পার্ল নদীর মোহনায় যাত্রা করে এবং ক্যান্টনে বোমাবর্ষণ শুরু করে। এতে ব্রিটিশ ও চীনা সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের ফলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সেখানে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। ডিসেম্বরে, ক্যান্টনে চীনারা বিদেশী কারখানা (বাণিজ্য গুদাম) পুড়িয়ে দেয় এবং ফলস্বরুপ উত্তেজনার মাত্রা চরম আকার ধারন করে।
ফরাসিরা ১৮৫৬ সালের প্রথম দিকে, চীনের অভ্যন্তরে একজন ফরাসি ধর্মপ্রচারককে হত্যার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ সামরিক অভিযানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মিত্র বাহিনী ১৮৫৭ সালের শেষের দিকে, চীনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। তারা দ্রুত ক্যান্টন দখল, শহরের গভর্নরকে পদচ্যুত  এবং সেখানে একজন অনুগত কর্মকর্তা নিয়োগ করে।
১৮৫৮ সালের মে, ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে মিত্র সৈন্যরা তিয়ানজিনে (তিয়েনসিন) পৌঁছে এবং চীনাদের আলোচনায় বাধ্য করে। ১৮৫৮ সালের জুনে, স্বাক্ষরিত তিয়ানজিনের চুক্তিগুলোতে বিদেশী দূতদের জন্য বেইজিংয়ে বাসস্থান, পশ্চিমা বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য বেশ কয়েকটি নতুন বন্দর খোলা, চীনের অভ্যন্তরে বিদেশী ভ্রমণের অধিকার এবং খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের চলাচলের স্বাধীনতা প্রদান করে। সাংহাইতে আরও আলোচনার পর, আফিম আমদানি বৈধ করা হয়।
১৮৫৮ সালের গ্রীষ্মে, ব্রিটিশরা তিয়ানজিন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। তারা চুক্তিগুলো অনুমোদন করার জন্য ফরাসি এবং ব্রিটিশ কূটনীতিকদের সাথে বেইজিং যাওয়ার পথে ১৮৫৯ সালের জুন মাসে, চীনারা তাদের হাই নদীর মুখে দাগু দুর্গের পাশ দিয়ে যেতে দিতে অস্বীকার করে এবং বেইজিংয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিকল্প পথের প্রস্তাব দেয়। ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন বাহিনী অন্য পথ গ্রহণের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরিবর্তে দাগুকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এতে আবারও সংঘর্ষ বাঁধে, এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মিত্ররা ফিরে যায়। চীনারা পরবর্তীকালে চুক্তিগুলো অনুমোদন করতে অস্বীকার করে এবং ফলে মিত্ররা আবার শত্রুতা শুরু করে।
১৮৬০ সালের আগস্টে, যুদ্ধজাহাজ এবং ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যের একটি বৃহত্তর বাহিনী দাগু ব্যাটারি ধ্বংস করে। তারা তিয়ানজিনের দিকে অগ্রসর হয় এবং অক্টোবরে বেইজিং দখল করে লুণ্ঠন করে। তারপরে, সম্রাটের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ইউয়ানমিং গার্ডেন পুড়িয়ে দেয়। এত চীনারা বেইজিং কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়, এবং তারা তিয়ানজিনের চুক্তিগুলোও পালন করতে সম্মত হয়।