নিউজিল্যান্ডের ছড়িয়ে থাকা দ্বীপপুঞ্জগুলো বর্তমান সময়ে মাওরিদের স্বদেশভূমি। নিউজিল্যান্ড মূলত উত্তর দ্বীপ এবং দক্ষিণ দ্বীপ নিয়ে গঠিত। উত্তর দ্বীপের ভুমিরুপ সমতল এবং পাহাড়ি অঞ্চল। দক্ষিণ দ্বীপটি উত্তর দ্বীপের চেয়ে বড় এবং অধিক পর্বতমালা বেষ্টিত।
বর্তমানে মাওরি উপজাতিরা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮৬ ভাগ) উত্তর দ্বীপে বাস করে। এই দ্বীপপুঞ্জে মানুষের বসবাসের আগে প্রচুর বন ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
মাওরিরা মূলত পলিনেশিয়ান জাতিভুক্ত। তারা পলিনেশিয়ান দ্বীপের মধ্যে বসবাসকারী স্থানীয় জনগণের জাতিগত জ্ঞাতিভাই। মাওরি সহ এই অঞ্চলের লোকদের একই রকম রীতিনীতি এবং সামাজিক জীবন রয়েছে। এছাড়া ইহকাল এবং পরকাল সম্পর্কে তাদের একই রকম বিশ্বাস রয়েছে।
মাওরি উপজাতি তাদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী পূর্ণ-শরীরে এবং মুখের উলকি বা ট্যাটু আঁকার জন্য সুপরিচিত। আদিবাসী হিসেবে বিশ্বে তাদের একটি অনন্য মর্যাদা রয়েছে।
১৩০০ খ্রিস্ট্রাব্দে সর্বপ্রথম মাওরিরা নিউজিল্যান্ডে আগমন করে। ১৬৪২ সালের ডিসেম্বরে, প্রথম ইউরোপীয়ান হাবিল তাসমান নিউজিল্যান্ড এর দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছায় এবং মাওরিদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের কারণে হাবিল তাসমান নিউজিল্যান্ডের বাকি দ্বীপগুলো আবিষ্কার না করেই চলে যান।
১৭৬৯- ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক নিউজিল্যান্ডের দুটি প্রধান দ্বীপপুঞ্জ জলপথে প্রদক্ষিণ করেন এবং উপনিবেশিকতার জন্য নিউজিল্যান্ডকে উপযুক্ত মনে করেন। এর পর থেকেই ক্রমাগত পাশ্চাত্য মিশনারিদের আগমনের সাথে সাথে মাওরি সংস্কৃতি এবং সামাজিক কাঠামোটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৮৩০ এর শেষের দিকে, নিউজিল্যান্ড ইউরোপে যোগদান করে। যার ফলে, ইউরোপীয়দের লোকেরা এইসব দ্বীপে আসতে শুরু করে।
১৮৪০ সালে ব্রিটিশরা নিউজিল্যান্ডের আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পরে, ইউরোপীয় আবাস এবং ইউরোপিয় সরকার মাওরিদের শঙ্কিত করে। ১৮৪৫ সালে কিছু মাওরি সর্দার দ্বীপসাগর উপকূলে এবং উত্তরের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে ইউরোপীয়দের আক্রমণ শুরু করে। এটাকে অনেকে প্রথম মাওরি যুদ্ধ বলে অভিহিত করে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থায় ভূমিকা পালন করে আসছে, যখন মাওরি সদস্যরা প্রথম সংসদে প্রবেশ করে। বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের সংসদে মোট ১২০ টি আসনের মধ্যে ৭ টি আসন মাওরির জন্য সংরক্ষিত থাকে।
মাওরি উপজাতিরা সভা ঘরে প্রবেশ করার আগে জুতো এবং টুপি খুলে পেলে। শুধুমাত্র সভার প্রধান জুতা পায়ে রাখতে পারেন। সভা ঘরে প্রবেশের পূর্বে জুতো এবং টুপি খুলে ফেলা শ্রদ্ধার নিদর্শন এবং এটা তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষের সাথে খালি পায়ে এবং উন্মুক্ত মন দিয়ে সংযোগ করতে সাহার্য্য করে।
মাওরিরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যারা আকাশ, পৃথিবী, বন এবং প্রকৃতি ইত্যাদি শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মাদের প্রয়োজন বা যুদ্ধের সময় সাহায্য করার জন্য আহ্বান করা যেতে পারে। মাওরি সংস্কৃতিতে গান, শিল্প, নৃত্য এবং গভীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ।
পাভিরি হল মাওরিদের স্বাগত অনুষ্ঠান, যার মধ্যে আলোচনা, নাচ, গান এবং হঙ্গি অন্তর্ভুক্ত। মাওরি সম্প্রদায়ের প্রধান কিছু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিম্নে আলোচনা করা হল,
১. Hongi
মাওরিদের প্রথাগত শুভেচ্ছা হচ্ছে হঙ্গি, যার অর্থ শ্বাস ভাগ করে নেওয়া। হঙ্গির মাধ্যমে একে অপরকে নাক এবং কপাল টিপে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এটি হ্যান্ডশেক করার সমতুল্য, তবে উভয়ের মুখ কাছাকাছি থাকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা এবং জীবনের দম হিসাবে পরিচিত।
২. Haka
হাকা হচ্ছে মাওরিদের যুদ্ধ নৃত্য। অ্যাকশন-প্যাকড নাচটি শক্তি এবং গর্বের প্রদর্শন, যার মধ্যে রয়েছে পায়ে শক্তিশালী স্টম্পস, প্রশস্ত চোখ এবং সুপরিচিত জিহ্বা বের করা। তবে এখন হাকা নৃত্য মাওরি অনুষ্ঠান, উদযাপন এবং অতিথিদের সম্মান জানাতে ব্যবহৃত হয়।
৩. Ta Moko
টা মোকো হচ্ছে মাওরিদের ব্যক্তিগত পদ এবং জ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা। এই ট্যাটু সাধারণত পুরুষদের মুখ, দেহের নিচের অংশে অঙ্কিত করা হয়। মহিলারা তাদের উরুতে, ঠোঁটে এবং চিবুকের উপর সবচেয়ে বেশি ট্যাটু আঁকে।