বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে যেকোন আইন প্রণনের ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র জাতীয় সংসদের কাছে। আইনসভার বিভিন্ন কাজের মধ্যে আইন প্রণয়ন একটি দীর্ঘ এবং কিছুটা জটিল প্রক্রিয়া। সংসদের এই আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত। সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে। আইন প্রণয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদে। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ণে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। নিম্মে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া সমূহ আলোচনা করা হল।

আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া

আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ৩টি পর্যায় রয়েছে। যেমন প্রাক লেজিসলেটিভ পর্যায়, লেজিসলেটিভ পর্যায়, এবং পোস্ট লেজিসলেটিভ পর্যায়।

আইনের প্রাথমিক খসড়া বা ড্রাপ্টকে সাধারণত বিল বলে। আইন তৈরি করতে সংসদে খসড়া আকারে এই বিল উত্থাপিত হয়। বিল মূলত দু‘ভাগে বিভক্ত,
১. সরকারি বিল, এবং
২. বেসরকারি বিল।
বাংলাদেশে আইনের তিনটি প্রধান শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে: সাধারণ বিল, অর্থ বিল এবং আর্থিক বিল। সাধারণ বিলের সাথে আর্থিক বিষয়গুলোর কোন সম্পর্ক থাকে না। এটি পার্লামেন্টে সাংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হতে পারে। সাধারণ বিল মূলত পাবলিক বিল এবং প্রাইভেট বিলে বিভক্ত। যদি বিলটি প্রবর্তনের জন্য কোন মন্ত্রী কর্তৃক নোটিশ দেওয়া হয়, তাহলে এটি একটি সরকারী/পাবলিক বিল নামে পরিচিত। যদি একজন এমপি এটি প্রস্তাব করেন, তাহলে এটি প্রাইভেট মেম্বার বিল/বেসরকারি বিল নামে পরিচিত। বেসরকারি বিল সংসদে উত্থাপনের জন্য রাষ্ট্রপতির সুপারিশের প্রয়োজন নেই। কিন্তু “অর্থ বিল” এবং “আর্থিক বিল” উভয়ের জন্য রাষ্ট্রপতির পূর্ব সুপারিশ প্রয়োজন।
সংসদে বিল পেশ করার আগে, এটি কিছু প্রাক লেজিসলেটিভ পর্যায় অনুসরণ করে যেমন; খসড়া, নীতি উন্নয়ন এবং মন্ত্রিসভার অনুমোদন। প্রি-লেজিসলেটিভ পর্যায়ে সমস্ত প্রাক-আইনী কার্যক্রম জড়িত। সংসদে একটি বিল তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় অতিক্রম করে যা আইনসভা পর্যায় হিসাবে পরিচিত।
সংসদীয় ভাষায়, এই তিনটি পর্যায় হলো প্রথম পাঠ (বিলের শিরোনাম ঘোষণা করা), দ্বিতীয় পাঠ (বিলের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা), এবং তৃতীয় পাঠ (বিল পাস করা)।
সরকারি বা বেসরকারি কোন বিলকে আইনে পরিণত করতে সাধারণত ৫টি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। যথাক্রমে,
১. বিল উত্থাপন
২. প্রথম পাঠ (বিলের শিরোনাম ঘোষণা করা)
৩. দ্বিতীয় পাঠ (বিলের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা)
৪. তৃতীয় পাঠ ((বিল পাস করার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া)
৫. রাষ্ট্রপতির সম্মতি ও গেজেট প্রকাশ
বিল উত্থাপন: আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সাংসদ কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবকে বেসরকারি বিল বলে। অন্যদিকে, মন্ত্রী কর্তৃক ‍উত্থাপিত বিলকে সরকারি বিল বলে। কো‌নো বিল সংস‌দে উত্থাপ‌নের পূ‌র্বে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস‌্যদের বিল‌টির এক‌টি অনু‌লি‌পি প্রদান করা হয়।
প্রথম পাঠ: কো‌নো বিল সংসদে উপস্থাপ‌ন করাকে ফার্স্ট রিডিং বলা হয়। বিল সংসদে পেশের অনুমতি পাওয়ার পর, প্রস্তাবক কর্তৃক খসড়া বিলটি প্রথমবারের মত পঠিত হয়। প্রথম পাঠ শেষে, একজন প্রস্তাবক নিম্মোক্ত প্রস্তাবগুলো রাখতে পারে। যেমন,
  • খসড়া বিলটি বিবেচনা করার জন্য স্থায়ী কমিটির নিকট পাঠানো হোক।
  • সিলেক্ট কমিটির নিকট পাঠানো হোক।
  • জনমত যাচাইয়ের জন্য জনসমক্ষে প্রচার হোক।
  • বিলটি দ্বিতীয়বার পাঠ হোক।
দ্বিতীয় পাঠ: প্রথম পাঠ শেষে, বিল‌টির বিশদ আলোচনার জন্য আ‌রো এক‌টি তা‌রিখ নির্ধারণ করা হয়, যা‌কে বিল‌টির সে‌কেন্ড রি‌ডিং বলা হয়। এ পর্যায়ে বিল‌টির বিশদ আ‌লোচনা করা হ‌তে পা‌রে অথবা বিল‌টির জনমত যাচাই করার জন‌্য সে‌টি একটি স্থায়ী বা বাছাই ক‌মি‌টির নিকট প্রচার করা যে‌তে পা‌রে।প্রস্তাবক বিলটি বিবেচনা করতে সংসদের নিকট অনুরোধ জানাবেন। সংসদ সদস্যরা বিলটির প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব আনবেন। শেষে, স্পীকার প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
তৃতীয় পাঠ: কো‌নো বিল সে‌কেন্ড রি‌ডিংয়ে পাস করা হ‌লে তাকে থার্ড রি‌ডিং বলা হয়। কো‌নো স্থায়ী বা বাছাই ক‌মি‌টির নিকট প্রচার করা হ‌লে, সেই ক‌মি‌টি ‌রি‌পোর্টসহ বিল‌টি পূনরায় সংস‌দে প্রেরণ কর‌বে এবং তারপর সে‌টি রি‌পোটর্সহ বি‌বেচনা করা হ‌বে। প্রস্তাবকৃত বিলটির যাবতীয় ধারা, উপধারা বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় সংশোধনী গ্রহণ ও বর্জনের জন্য সংসদে বিলটি তৃতীয় পাঠের অনুরোধ করবেন। পরবর্তীতে, স্পীকার বিলটি গ্রহণ করবে কি না এবিষয়ে হ্যা বা না ভোটের আয়োজন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে বিলটি গৃহীত হলে স্পীকার সাক্ষর করে রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠাবে।
রাষ্ট্রপতির সম্মতি: রাষ্ট্রপতির নিকট ফেরিত বিলটি অনধিক ১৫ দিনের মধ্যে সম্মতি দিলে তা আইনে পরিণত হবে। আর যদি কোন সংশোধনী দরকার হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি বিলটি ফেরত পাঠাবেন। সংসদ বিলটি পুনরায় পর্যালোচনা করবে। তবে, কোন কারণে রাষ্ট্রপতি যদি সম্মত দিতে অপারগ হয়, তাহলে বিলটি সরাসরি আইনে পরিণত হবে।

Similar Posts