ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (Thirty Years War), জার্মানিতে সংঘটিত হওয়া ইউরোপের ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। যুদ্ধটিতে ইউরোপের প্রায় সকল দেশই এর সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত ছিল।
ত্রিশ বছরের যুদ্ধ ছিল ১৭ শতকের একটি ধর্মীয় সংঘাত যা মূলত মধ্য ইউরোপে সংঘটিত হয়েছিল। এটি মানব ইতিহাসের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি, সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ এবং সংঘাতের কারণে সৃষ্ট রোগের ফলে ৮ মিলিয়নেরও বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত, সংঘাত ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক চেহারা এবং সমাজে ধর্ম ও জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বদলে দিয়েছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে ত্রিশ বছরের (১৬১৮ – ১৬৪৮) যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। প্রাথমিকভাবে যদিও ধর্মই এই যুদ্ধের একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত ছিল কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যুদ্ধটি ধর্ম ও রাজনীতির কারণে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যা একসময় একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপ নেয়।
ইউরোপের ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৬১৮ সালে যে ভীতিকর ও ধ্বংসাত্মক ত্রিশ বছরের ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়, যার অবসান ঘটে ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মাধ্যমে।
প্রথমদিকে, যুদ্ধটি ছিল রোমান সম্রাজ্যের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যকার ধর্মযুদ্ধ। পরবর্তীতে, সম্রাজ্যের মধ্যকার রাজনীতি নিয়ে বিরোধ এবং শক্তির ভারসাম্যেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এতে। ফলস্বরুপ, ধীরে ধীরে এটি সাধারণ এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপ নেয় যাতে ইউরোপের অধিকাংশ শক্তি অংশ নিতে বাধ্য হয়। ধর্মীয় যুদ্ধটি একসময় ধর্মের চেয়েও অনেক বড় হয়ে দেখা দেয় ইউরোপের প্রধান শক্তি হওয়া।
১৬১৯ সালে সম্রাট ফার্ডিনান্ড দ্বিতীয়ের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধানে আরোহণের সাথে সাথে ধর্মীয় সংঘাত শুরু হয়। ফার্ডিনান্ড II এর প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল নাগরিকদের রোমান ক্যাথলিক ধর্ম মেনে চলতে বাধ্য করা, যদিও অগসবার্গের শান্তির অংশ হিসাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল।
১৫৫৫ সালের অগসবার্গের শান্তির মূল নীতি ছিল ‘‘যার রাজ্য, তার ধর্ম’, যা রাজ্যের রাজকুমারদের তাদের নিজ নিজ ডোমেনের মধ্যে লুথারানিজম/ক্যালভিনিজম বা ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করার অনুমতি দেয়।
ফরাসি সম্পৃক্ততা
ফরাসিরা, যদিও ক্যাথলিক, তারা হ্যাবসবার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এবং প্রাগের শান্তির বিধানে অসন্তুষ্ট ছিল। এইভাবে, ফরাসিরা ১৬৩৫ সালে সংঘাতে প্রবেশ করে। যাইহোক, ১৬৩৭ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে ফার্ডিনান্ড II মারা যাওয়ার পরেও, ফার্ডিনান্ড II এর বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারেনি।
এদিকে, স্পেন, সম্রাটের উত্তরাধিকারী এবং পুত্র ফার্দিনান্দ তৃতীয়ের নির্দেশে এবং পরবর্তীতে লিওপোল্ড I-এর অধীনে যুদ্ধ করে, পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ১৬৩৬ সালে প্যারিসকে হুমকির মুখে ফেলে ফরাসি অঞ্চল আক্রমণ করে। যাইহোক, প্রোটেস্ট্যান্ট জোট এবং স্পেন এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বাহিনী পরবর্তী কয়েক বছর ধরে অচলাবস্থায় ছিল।
১৬৪০ সালে, পর্তুগিজরা তাদের স্প্যানিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে, যার ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে তাদের সামরিক প্রচেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়ে। দুই বছর পর, সুইডিশরা আবারও ময়দানে প্রবেশ করে, হ্যাবসবার্গ বাহিনীকে আরও দুর্বল করে।
ধর্মীয় কারণ
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে, জার্মানি ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয় সম্প্রদায়ের অনমনীয় ও আপোষহীন মনোভাব পোষণ করে এবং আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রোটেস্ট্যান্টরা আবার লুথারপন্থী ও কেলভিনপন্থী এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরই পরিপেক্ষিতে, ১৫৫৫ সালে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে অগসবার্গ শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু এই চুক্তির রোমান সাম্রাজ্যের কোন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বা অমীমাংসিত বিষয় সমূহের কোন সম্মানজনক মীমাংসা দিতে পারেনি।
রাজনৈতিক কারণ
ধর্মীয় কারণে ৩০ বছর ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলেও এর পিছনের রাজনৈতিক কারণও বিদ্যামান ছিল। সেসময় প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক বিষয়ে ইউরোপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। রোমান সম্রাটের দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড এ দ্বন্দ্বের সুযোগে জার্মানিতে নিজ প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করেন।
আবার সুইডেনের রাজা গাস্টাভাস নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্য এবং বাল্টিকের সুইডেনের প্রভাব বিস্তার ও ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে রক্ষা করার নামে যুদ্ধে যোগদান করেন। অপরদিকে, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রিশল্যু নিজে ক্যাথলিক হয়েও স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গের প্রাধান্য খর্ব করার উদ্দেশ্যে প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য রাজন্যবর্গের নেতৃত্বে দুইটি পরস্পর বিরোধী জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৬০৮ সালে, প্রোটেস্ট্যান্টরা প্যালাটিনেট ও ক্যালভিনিস্ট রাজকুমার ফ্রেভারিখের নেতৃত্বে একটি ‘‘ইভানজেলিক ইউনিয়ন’’ গঠন করে। এর বিরুদ্ধে ১৬০৯ সালে ব্যাভারিয়ার ম্যাক্সিমিলিয়ানের নেতৃত্বে ক্যাথলিকরা ‘‘হোলি লীগ’’ (Holly League ) নামে অনুরূপ একটি জোট গঠন করে। এভাবে উভয় সম্প্রদায় যুদ্ধংদেহী জোট গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানিতে দ্বন্দ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
প্রাগের বিদ্রোহ
ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল বোহেমিয়ার রাজধানী প্রাগের বিদ্রোহ। বোহেমিয়ার অভিজাত শ্রেণী ছিল কেলভিনপন্থী। তারা অভিযোগ করে যে, চার্চ তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করছে। যেহেতু তাদের কোন ধর্মীয় মর্যাদা ছিল না, এজন্য তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৬০৯ সালে, রোমান সম্রাট রূডলফ তাদের ধর্মীয় মর্যাদা দিলেও গির্জা নির্মাণের জন্য জমি দানের ক্ষেত্রে সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছা জুড়ে দেয়। সামন্ত প্রভুরা জমিতে গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেননি।
এমতাবস্থায়, দ্বিতীয় ফার্ডিনান্দ রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়েই প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এটি প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে জাতীয় চেতনার সৃষ্টি করে। তারা সম্রাটের কাছে এর প্রতিকারের আবেদন করে সাড়া না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা রাজপ্রসাদে ঢুকে দুইজন রাজ প্রতিনিধিদেরকে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় এবং প্যালানিটের প্রোটেস্ট্যান্ট ফ্রেডারিখকে তারা বোহেমিয়ার রাজা বলে ঘোষণা করেন। এতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তা দ্রুত জার্মানি, ফ্রান্স ,নেদারল্যান্ড, হল্যান্ড ,সুইডেন, ডেনমার্কসহ সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ওয়েস্টফেলিয়া শান্তিচুক্তি জার্মানিকে তিনশত স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দেয়। প্রত্যেক শাসক তাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং আলাদা প্রতিরক্ষা ও শুল্ক নীতি গ্রহণ করে। এই সব রাষ্ট্রের উপর সম্রাটের প্রভাব কমে যাওয়ায় সাম্রাজ্য দুর্বল ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে। এর ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে উত্তর জার্মানিতে ব্রানডেনবার্গের (পরবর্তীকালে প্রাশিয়া) হিসাবে গড়ে উঠে। এটি অস্ট্রিয়ার আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব কে চ্যালেঞ্জ করে এবং শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জার্মানির অভ্যুত্থান এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশ শতকে, বিসমার্ক এর নেতৃত্বে জার্মানির পূনরায় একত্রীকরণ হয়।
ত্রিশ বছরের যুদ্ধে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ। যুদ্ধে সৈনিকদের অত্যাচার, ধর্মীয় উন্মাদনা ও অবাধ হত্যাকান্ড জার্মানির বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গ্রামের পর গ্রাম জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হয়। জার্মানির বহু অংশে জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। এছাড়া জার্মানির দুই-তৃতীয়াংশ লোক নিহত হন। বহু গ্রাম জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
ত্রিশ বছরের যুদ্ধে জার্মানির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। জার্মানির সমৃদ্ধশালী শহরগুলোর ধ্বংসযজ্ঞে নিঃস্ব হয়ে যায়। ব্যাপক খাদ্যের অভাবে জার্মানি বহুৎ স্থানের লোক মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। যুদ্ধের পর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ফরাসি ও ডাচদের হাতে চলে যায়। যুদ্ধের পর শিল্পক্ষেত্রে জার্মানির অধঃপতন আরো বেড়ে যায়। ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র হ্যাসান, লিপজিগ,ম্যাগেডেবার্গ, হামবুর্গসহ বহু শহর ঘুমন্ত শহরে পরিণত হয়।
এই যুদ্ধে দৈহিক উৎপীড়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নৈতিকতার পতন ঘটে। ফলে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি দেশই এক একটি পশুর শক্তিতে পরিণত হয়। যুদ্ধের পর দয়া মায়া ও সহমর্মিতার স্থলে মানুষ নির্মম পশুতে পরিণত হয়। মানুষের অভ্যাস রীতিনীতি নৈতিকতা বিরোধী হতে থাকে।
ত্রিশ বছর যুদ্ধে জার্মানির শিল্পসাহিত্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জার্মানির সৃজনীশক্তি সৃষ্টিশীলতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মান সাহিত্য ,দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি ইতালি এবং ফ্রান্সের সমপর্যায়ভুক্ত ছিল। জার্মান ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন ক্রমশই নিম্নমুখী হতে শুরু করে, তেমনি জার্মানির বুদ্ধিজীবী জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির পরিমাণ কমতে থাকে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর, ফ্রান্সে শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটলেও জার্মানির এই অধঃপতন হতে পুনরুদ্ধার করতে বেশ সময় লাগে।
শেষ পর্যন্ত, যদিও, ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন যে ওয়েস্টফালিয়ার শান্তি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেছে, যুদ্ধে জড়িত দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সীমানা স্থাপন করেছে এবং কার্যকরভাবে আদেশ দিয়েছে যে একটি রাজ্যের বাসিন্দারা সেই রাজ্যের আইনের অধীন ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মীয়।
এটি ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্যকে আমূল পরিবর্তন করে এবং এর ফলে ক্যাথলিক চার্চের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক বিষয়ে প্রভাব হ্রাস পায়। ত্রিশ বছরের যুদ্ধে লড়াইটি যতটা নৃশংস ছিল, ততই সংঘাতের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ফলে এবং টাইফাসের মহামারীর ফলে লক্ষ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল।