রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
সর্বপ্রথম অষ্টম শতাব্দীতে, আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে (মিয়ানমার) মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
ইতিহাস ও ভূগোল থেকে জানা যায় যে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বহুকাল ধরে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। এছাড়া উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে প্রধানত দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস মগ ও রোহিঙ্গা। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
যদিও গত ৮’শ বছরে বর্মিজ, জাপানিজ ও মগ সৈন্যদের নিপীড়নে বহুবার তাদেরকে জন্মভূমি থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তারা দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ বাংলাদেশের টেকনাফ ও কক্সবাজার উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে। তবে, সুযোগ পেলেই কৃষিজীবী রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেছে বারবার।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটিজাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। তবে, সেসময় আরাকানের রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবেও উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোসাঙ্গ স্বাধীনরাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।
এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ-ভূখণ্ড। তখন তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভূল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা। যার ফলাফল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, মিয়ানমার ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সেসময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে, জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।
রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিকজান্তা রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ধর্মীয় কাজে বাধা ছাড়াও তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করেছে। হত্যা-ধর্ষণ ছিল নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয় এবং বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।
মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই বৈরিতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল এবং অনেক বৌদ্ধ জাপানিদের সমর্থন করেছিল। ১৯৪৮ সালে মায়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর, মুসলিমরা সমান অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল কিন্তু পরাজিত হয়, সেইসাথে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন আরও দৃঢ় করে।
১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, রোহিঙ্গাদের জন্য পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। সমস্ত নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড পেতে বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের শুধুমাত্র বিদেশী পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল, যা তাদের চাকরি এবং শিক্ষার সুযোগ সীমিত করেছিল।
১৯৮২ সালে, মিয়ানমার সরকার একটি নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে, যা কার্যকরভাবে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে। আইনের অধীনে, রোহিঙ্গাদের দেশের ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর একটি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আইনটিতে নাগরিকত্বের তিনটি স্তর ছিল। সর্বাধিক মৌলিক স্তর (প্রাকৃতিক নাগরিকত্ব) পাওয়ার জন্য প্রমাণ প্রয়োজন ছিল, যে ব্যক্তির পরিবার ১৯৪৮ সালের আগে মিয়ানমারে বাস করত, এবং সেইসাথে জাতীয় ভাষায় সাবলীল কথা বলতে পারে। অনেক রোহিঙ্গার কাছে এই ধরনের কাগজপত্রের অভাব ছিল এবং তারা মিয়ানমারের জাতীয় ভাষায় সাবলিলভাবে কথাও বলতে পারতো না।
ফলস্বরূপ, তাদের পড়াশোনা, কাজ, ভ্রমণ, বিয়ে, তাদের ধর্ম পালন এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা অ্যাক্সেস করার অধিকার সীমাবদ্ধ ছিল। রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারত না, এবং তাদের কিছু পেশা যেমন ওষুধ বা আইন বা অফিসের জন্য দৌড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা স্থাপন করা হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে স্থানান্তরের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৭৮ সালের দিকে। ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে আরেকটি অভিবাসন ঘটেছিল। ১৯৯২ সালের আগে, যারা বাংলাদেশে চলে এসেছিল, তারা মিয়ানমার সীমান্তের কাছে কক্সবাজারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের তদন্তের প্রতিবেদন অনুসারে রোহিঙ্গারা মায়ানমারের ভিতরে অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা ঘৃণা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছে। একই সাথে মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, অবৈধ গ্রেফতার, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক সহিংসতা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালে ব্যাপক সহিংসতার শুরু হওয়ার পর ১০,০০০০০-এরও বেশি লোক যাদের অর্ধেক শিশু – বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। চলমান সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা স্থলপথে বা নৌকাযোগে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে এসেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার পর মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরোদ্ধে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন”শুরু করে। এই অপারেশনে ৪০০-৩০০০ রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।