আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কি? সংজ্ঞা ও তত্ত্ব

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কি?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations) এমন একটি বিষয় যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, কূটনীতি, স্বার্থগােষ্ঠী, জনমত, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্ব বাণিজ্য, বিশ্ব পরিবেশ, বিশ্বায়ন প্রভৃতির মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শব্দটি জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করতে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্ককে বোঝায়। বর্তমানে পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যা সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ বা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রতিটি রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া বিশ্বে সকল প্রকারের সংঘাত, ও যুদ্ধ ইত্যাদি পরিহার করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি প্রধানত পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতি আরও তীব্র হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক সূচনা বিন্দু ছিল ওয়েস্টফালিয়া চুক্তি যেখানে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব হয়েছিল। চুক্তিটি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হিসাবে সার্বভৌমত্বের নীতিও প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯ শতক পর্যন্ত, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং সাহিত্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়নের উপর সীমিত ফোকাস ছিল।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের জন্য একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। প্রথমটি ছিল ১৯ শতকের শেষের দিকে, সাম্রাজ্যবাদ যা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে বিশ্বায়ন করতে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে সংযোগকে দৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল। দ্বিতীয়টি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মকতা এবং এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা।
১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তি সংক্রান্ত ডিক্রি এবং ১৯১৮ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ১৪ দফা নীতিগুলোও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসাবে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা কঠিন। তথাপি, কিছু ঐতিহাসিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের নিজেদের মত করে সংজ্ঞা দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল রাষ্ট্র, আন্তঃসরকারি সংস্থা, বেসরকারী সংস্থা, আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা এবং বহু-জাতীয় কর্পোরেশনগুলোর মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যয়ন।
অধ্যাপক হলটির মতে, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা পর্যালােচনাকে বুঝিয়েছেন।’’
প্রফেসর চার্লস শ্লেইচার আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে সম্পর্ক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
প্রফেসর হান্স মরজেনথাউ-এর মতে, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হচ্ছে জাতি সমূহের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।’
হার্টম্যানের মতে, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলােচনা করে।’’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব

আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব তা ব্যাখ্যা করে।
সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামাে বিন্যাস ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুসংবদ্ধ আলােচনা সম্ভব নয়, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারার অবদান রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধ্রুপদি তিনটি তত্ত্ব হল বাস্তববাদ, উদারতাবাদ এবং কাঠামোবাদ।
পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে, তার উপর ভিত্তি করেই নিম্নলিখিত তত্ত্বগুলো গড়ে উঠেছে।
১. বাস্তববাদ (Realism)
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্ব মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল কথা হল ক্ষমতা।  অধ্যাপক হ্যান্স জে মরগেনথাউ বলেছেন, ‘‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতি।’’  আধুনিক যুগের বাস্তববাদী চিন্তাবিদদের তত্ত্বসমূহের প্রধান তিনটি দিক হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, নৈরাজ্য ও আত্ম-নির্ভরশীলতা।
  • জাতীয়তাবাদ: বাস্তববাদীগণ বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান কর্তা।তাই এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক তত্ত্ব।
  • নৈরাজ্য: বাস্তববাদীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নৈরাজ্যের দ্বারা চালিত হয়, যার অর্থ হচ্ছে এই ব্যবস্থায় কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই। তাই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হচ্ছে স্বার্থপর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
  • আত্ম-নির্ভরশীলতা: বাস্তববাদীরা মনে করে, কোন রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা যায় না।
২. উদারতাবাদ (Liberalism)
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারতাবাদ তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া কেবল রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপরও নির্ভর করে, আর তাই এটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠনসমূহ ও এমনকি ব্যক্তির উপরেও নির্ভরশীল।
৩. কাঠামোবাদ (Structuralism)
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামােগত মতবাদীরা শােষিত ও শােষক শ্রেণির রাষ্ট্রের মানদণ্ডে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন অর্থাৎ প্রভুত্বকারী শ্রেণিভিত্তিক রাষ্ট্র হল বিশ্ব রাজনীতির মূল কর্মকর্তা। কাঠামােবাদীরা মনে করেন, আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গুটিকয়েক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং তার চারপাশে বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রসমূহ।

Similar Posts